ফিলাডেলফিয়ায় আমাদের একটা নিরিবিলি ঠিকানা আছে, যেটাকে আমি বলি – একটি ছোট্ট ঘাঁটি। আজকাল প্রায়ই দু-এক দিনের জন্য আমাদের সেখানে যাওয়া হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি আবার যাওয়ার একটা পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু জীবন তো সবসময় আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না। যেমনটা বলা হয়—“Man proposes, God disposes”, ঠিক তেমনই, একদিনের নোটিশে গড তার খেয়ালমতো একটা কাজ এনে হাজির করলেন আমাদের নাকের ডগায়।
ফলে, ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল সকাল আমাদের রওনা দিতে হলো ছোট্ট ঘাঁটিতে।
এই ছোট ঘাঁটির বাইরেও ফিলাডেলফিয়ায় আমার কজন বন্ধু-পরিবার রয়েছে। যখনই যাই ওঁদের সংগে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দেখা হয়, আড্ডা হয়।

সেইদিন, ২৮ সেপ্টেম্বর, ফরিদা পারভীন স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন বন্ধু-পরিবারের লেখক বদরুজ্জামান আলমগীর ও ফিলাডেলফিয়া পত্রিকা-র সম্পাদক আহমেদ সায়েম এবং তাঁদের বন্ধু সংগঠন ‘বলাকা’((Bangladesh Arts Legacy and Cultural Association – BALACA)। অনুষ্ঠানের বিস্তারিত আমার জানা থাকলেও, উপস্থিত থাকার কথা ছিল না। কিন্তু হুট করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানাতেই আমন্ত্রণ এলো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য।
এই অনুষ্ঠানের উপলক্ষে ফিলাডেলফিয়া পত্রিকা-তেও ফরিদা পারভীন স্মরণে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। কাজেই কিছু ‘বলব না’— এই অজুহাত, আপত্তির জোর টিকলো না । ‘উঠরে মেয়ে তোর বিয়ে’-র মতো বলা হলেও, শেষপর্যন্ত যে কাজে যাওয়া তা সেরে, মাথায় একটা পাঁচ মিনিটের খসড়া নিয়ে বিকেলে অনুষ্ঠানে হাজির হলাম।
‘ফরিদা পারভীন পরম সন্ধ্যা’— এই শ্রদ্ধার আয়োজনে বলাকা’র কলাকুশলীরা উপহার দিলেন এক মন ছুঁয়ে যাওয়া সন্ধ্যা যা ছিল আন্তরিক ও সুচিন্তিত নিবেদনে সাজানো। লালনকে নিয়ে কবিতা পাঠের আসর, লালনগীত পরিবেশনা আলোচনা, আর স্মৃতিচারণায় কেটে গেল ফরিদা পারভীনের প্রতি ভালোবাসায় মোড়ানো মুহূর্তগুলো।
আমি ভেবেছিলাম খুব অল্প সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে হলরুমটি ভর্তি হয়ে গেল। অনেকে পুরো অনুষ্ঠান দাঁড়িয়ে উপভোগ করলেন।
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে গাওয়া রেকর্ডকৃত লালনগীতি ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’ দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা, আর সমাপ্তি হয় ‘ফরিদা পারভীন – মানুশগুরু, নিষ্ঠা যার’ শিরোনামের আলোচনা ও মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে
সত্যি বলতে, এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল এই আয়োজনে। কিছুটা আনুষ্ঠানিক, অনেকটাই ঘরোয়া ও অন্তরঙ্গ।
গোটা অনুষ্ঠানই ছিল লালনময়। এমন পরিবেশে সরাসরি আলোচনায় হঠাৎ করে যুক্ত হতে পেরেও ভালো লেগেছে।
ফরিদা পারভীনকে নিয়ে আমার আলোচনায় বারবার লালন ফিরে এলেন ।
লালন ছাড়া ফরিদা পারভীনের কথা যেমন বলা যায় না, ফরিদা পারভীনকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে, লালনের কথা না বললেই নয়। লালনের গান বললে ফরিদা পারভীনের নাম আসবেই—এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তিনি যে শুধু লালনগীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বরং তার কণ্ঠ যেন ছিল লালনের গান ধারণের জন্যই সৃষ্টি। সত্যি বলতে, তিনি যেভাবে লালনকে নিজের ভেতর ধারণ করেছিলেন—তার তুলনা মেলা ভার।
এক মিনিট সুন্দরকে সুন্দর বলার আনন্দই যেন ভাগ করে নিলেন আমাদের সঙ্গে। শাড়ির সৌন্দর্যকে প্রশংসা করে, হারমোনিয়াম টেনে নিলেন, চোখ বন্ধ করলেন, আর গেয়ে উঠলেন: “মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার” । যে গানের মাধ্যমে লালন বোঝাতে চেয়েছেন সত্য পথে চলার শিক্ষা, আত্মশুদ্ধির শক্তি, এবং মানবিকতার বার্তা।
তাকে নিয়ে কিছু কথা বলতে গিয়ে মনে পড়লো, একবার তার এক সাক্ষাৎকার দেখছিলাম, ফরিদা পারভীন বলেছিলেন, কলকাতার এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন: “আপনাদের লালন ফকিরের গান আর আমাদের লালনের গানের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি?”
ফরিদা পারভীনের উত্তর ছিল— “আমাদেরটা হয়, আপনাদেরটা হয় না।”
কেন বলেছিলেন? কারণ, লোকগীতি বা ট্র্যাডিশনাল গান মূলত অঞ্চলভিত্তিক। লালন ছিলেন কুষ্টিয়ার। ফলে তার গান সেই অঞ্চলের ভাষা, টান, লোকজ বোধে গড়া। মুখে মুখে ছড়িয়ে থাকা সেই গান কলকাতায় এসে অনেক সময়েই তার আসল রূপ হারিয়ে ফেলে। আর ফরিদা পারভীন তো মূল ঘরানা থেকেই শিখেছেন। তাই জোর গলায় সেটা বলার অধিকারও তার ছিল।
‘‘সত্য বলো, সুপথে চল” দিয়ে শুরু হয়েছিল তার লালন-যাত্রা। লালনপ্রভাবিত জীবনই ছিল তার জীবনদর্শনের মূল।
২০২২ সালে নিউইয়র্কের লালন উৎসবের পরে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন “ফকিরের গান না করলে মৌলবাদের ছোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারতাম না। আত্মশুদ্ধি করতে পারতাম না, মানবতার কথা জানতাম না, সমাজ সংস্কারের কথা বলতে পারতাম না, প্রেম সৃষ্টি করতে পারতাম না।”
লালনের কোনো লিখিত দর্শন নেই। তাঁর গানেই ছিল দর্শন— জাগতিক মোহ ত্যাগ করে আত্মশুদ্ধির পথেই ছিল তার গান ও ভাবনার মূল সুর।
লালনগীতি আমাদের শেখায়—কীভাবে আত্মকেন্দ্রিকতা ছেড়ে সহানুভূতিশীল, মানবিক হয়ে উঠতে হয়।

ফরিদা পারভীন আমাদের মনে এত গভীর ছাপ রেখে গেলেন কেন? কারণ তিনি গান গাওয়ার আগে লালনের কথা নিজের ভেতরে নিতেন, অনুভব করতেন—তারপর গাইতেন। আমার নিজের মেয়ে, এদেশে বড় হলেও, ফরিদা পারভীনকে চেনে শুধু তার কণ্ঠের জন্য, আর লালনের নাম জানে তাঁর মাধ্যমেই।
ফরিদা পারভীন এখন আর নেই। হয়ত ভবিষ্যতে কেউ আসবেন, যিনি এই ভাবনা বয়ে নিয়ে যাবেন। তবে আমাদেরও লালন ভাবনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে।
আমরা অনুষ্ঠান করব, গান গাইব, আলোচনা করব—তবে লালনের গানের ভিতরকার দর্শনকে যত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, ততই এই সব আয়োজন অর্থবহ হবে।
যখন দেখি এত বছর ধরে কেবল লালনের জন্মস্থান বা জাতধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়, অথচ তার গানের ভিতরের মূল ভাব নিয়ে তেমন কিছু বলা হয় না—তখন কষ্ট হয়।
লালনের উপর শতশত পাতার গবেষণাগ্রন্থেও সেই একই বিতর্ক ঘুরেফিরে আসে, গান ও দর্শন উপেক্ষিত থাকে— যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
তাই শুধু গান বা অনুষ্ঠান নয়—লালনের দর্শন, তার মানবতা ও আত্মশুদ্ধির বাণী আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে হবে।
ফরিদা পারভীনকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়লো — তিনি সবসময় জামদানি আর হালকা গয়না পরতেন, রুদ্রাক্ষের মালা নয়। ২০২২ এর সেই ঘরোয়া আড্ডার দিনটিতেও তিনি জামদানি পরেছিলেন। শাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টাও করেছিলেন। অবাক লাগছিলো প্রথম, কিন্তু আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম— সত্যিই তো, শাড়ি তো একটি শিল্প। সেলাইবিহীন বারো হাত কাপড় আর কোনো জাতির নারীরা এমনভাবে পরতে পারেন? শাড়ির এই গল্পটা হালকা হলেও তা আমাদের সংস্কৃতির গভীর প্রতীক। শাড়ির প্রশংসা তো আর এড়ানো যায় না—তিনি করলেনও, হালকা হাসি আর চোখের চাউনিতে।
এক মিনিট সুন্দরকে সুন্দর বলার আনন্দই যেন ভাগ করে নিলেন আমাদের সঙ্গে। শাড়ির সৌন্দর্যকে প্রশংসা করে, হারমোনিয়াম টেনে নিলেন, চোখ বন্ধ করলেন, আর গেয়ে উঠলেন: “মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার” । যে গানের মাধ্যমে লালন বোঝাতে চেয়েছেন সত্য পথে চলার শিক্ষা, আত্মশুদ্ধির শক্তি, এবং মানবিকতার বার্তা।
ফিলাডেলফিয়ার সেই সন্ধ্যায়, আলোচনা পর্বে সকলের সঙ্গে আমি ভাগ করে নিয়েছিলাম ফরিদা পারভীনের সঙ্গে আমার এইসব স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা।
এক অসাধারণ শিল্পীর প্রতি ভালোবাসা এবং অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা—এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই গড়ে উঠেছিল সেই পরম সন্ধ্যা।
…

যেন এক দ্বৈত সত্তার শিল্পী: একদিকে তিনি গল্পের কারিগর, শব্দের তুলিতে আঁকেন জীবনের ছবি; অন্যদিকে সময়ের দর্পণ, যেখানে রাজনীতি ও সমাজের নির্মোহ প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের নাগরিক হলেও, তাঁর বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার জগৎজুড়ে থাকে প্রতিদিনের বাংলাদেশ। তাঁর গল্পগুলো যেন সময়ের নীরব সাক্ষী, যেখানে ইতিহাসের প্রাচীন পলিমাটি মিশে থাকে নৃতত্ত্বের গভীর শিকড়ের সাথে। এই মিশ্রণে জন্ম নেয় এক নির্দয় মায়ার জগৎ, যা পাঠককে আকর্ষণও করে, আবার বাস্তবতার কঠিন জমিনে দাঁড় করায়। তিনি শব্দের ফেরিওয়ালা নন, তিনি ওজন করে বাক্য সাজান না; বরং তিনি এক অনিবার্য প্রশ্নের জন্মদাত্রী, তাঁর কলম যেন এক তীব্র জিজ্ঞাসা, এবং পাঠকের মনে নতুন ভাবনার জন্ম দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। রাজিয়া নাজমী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার সাথে, একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে আইনশাস্ত্রেও ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ঢাকা বার কাউন্সিলের সনদ লাভ করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছেন।
প্রকাশিত বই – গল্পগ্রন্থ – চৌকাঠের বাইরে ,জলাগুন উপন্যাস- আধখানা হলুদ সুর্য
