জীবনের একটা মুক্তধারা সময় আমি ঢাকার মীরপুরে কাটিয়েছি। আমার ধারণা ছিল- হঠাৎ একদিন জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে! রক্তবীজ বলে একটা কথা আছে না- মাতঙ্গিনী মা কালীও যাকে নিঃশেষ করতে হাঁপিয়ে ওঠেন!
অবিরাম আমার প্রাণাশা ছিল মীরপুরের কোন না কোন কংক্রিটের নিচে নিশ্চয়ই জহির রায়হানের একফোঁটা অদম্য রক্ত লেগে আছে- যা থেকে একদিন তিনি রক্তবীজ ঠিকঠিক বেরিয়ে আসবেন।
সম্ভবত আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময় অগ্রজ খালেকুজ্জামান মতিনের কল্যাণে প্রথম জহির রায়হানের তৃষ্ণা উপন্যাসটি আমার হাতে আসে; তিনি কিশোরগঞ্জ মহকুমা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে বইটি উপহার পেয়েছিলেন। পাঠ্য বইয়ে শাহজাহান স্যার, বা খসরু স্যার যে বাঙলা পড়ান- তার সঙ্গে তৃষ্ণার ভাষা ও ভাব মিলাতে আমার কপালে নির্ঘুম দশা নেমে আসে।
বিপুল মেলা উৎসবের জন্য নরবলি লাগে; জহির রায়হান ছাড়া আর কার এমন বুকের পাটা যে বুক চিতিয়ে খাঁড়ার নিচে মাথা গলিয়ে দিতে পারেন?
জহির রায়হানের দিকে তাকিয়ে আমরা অবলীলায় শতাশতি বাজারী ইন্টেলেকচুয়ালদের খারিজ করি; জহির রায়হানের একটি লাইন ধার করেই বলি- ওদের জানিয়ে দাও। ওরা বুদ্ধিপাইকার।
কলেজে ভর্তি হবার মারাত্মক কালে আমার আরেক অগ্রজ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের বরাতে জহির রায়হানের সবগুলো উপন্যাস আমার হাতে আসে। জহির রায়হানের উপন্যাসের ভিতর দিয়ে বাঙলাদেশ স্বাধীন হবার একটা অদ্ভুত যুক্তি আমার মাথায় ঢোকে- যে-পূর্ববাঙলায় এমন ভাষায় এরকম স্বপ্ন ও উপন্যাস লেখা হয়, সেই জনপদ আর পাকিস্তানের অধীনে থাকতে পারে না- পূর্ণ স্বাধীনতাবিহীন অন্য কোন আঁধিয়ারে তাকে আর মানায় না।
আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের শেষ লাইন- আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো- পড়েই মনের অজান্তে মনস্থির করি- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথমেই আমি ঢাকায় শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াবো।
মার্কসবাদে ঈমান আনার পর প্রথম যে আতঙ্কে কাবু হই- তা হলো, বড় বড় অনেক মার্কসবাদী লেখক নামতার মতো করে লেখেন- তিনি সারাক্ষণ তটস্থ থাকেন তা যেন মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের ফর্মুলার বাইরে না যায়। এক্ষেত্রেও জহির রায়হানকে এক কার্যকর ব্যতিক্রম হিসাবে পাই।
আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের বুনন আর চালচিত্র তৃষ্ণা, বা হাজার বছর ধরে থেকে মৌলিকভাবে আলাদা; বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের চড়াই-উতরাই, ওঠানামার কড়চা; অন্যদিকে আর কতদিন তাঁর এক বিশ্ববীক্ষা। জহির রায়হান লেট দেয়ার বি লাইট-এর বাঙলা করেছিলেন আর কতদিন। বাইবেলের জেনেসিস পর্ব থেকে লেট দেয়ার বি লাইট পদ নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু বাইবেলীয় একচ্ছত্রতার জায়গায় ঠেসে দিয়েছিলেন পরাধীন মাতৃভূমি ও ক্লেদাক্ত দুনিয়ার মুক্তির বাসনা।
সিনেমায় জহির রায়হানের স্বপ্ন কল্পনা ঠিক অন্য কোন বাঙালি চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে মেলে না। জাগো হুয়া সাভেরা চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করতে গিয়ে জহির রায়হান পরিচিত হয়েছিলেন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সঙ্গে, লেট দেয়ার বি লাইটের উর্দু ভার্শনে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কাজ করার কথা ছিল।
বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া, কখনো আসেনি থেকে স্টপ জেনোসাইড পর্যন্ত জহির রায়হানের অন্বেষা, সংযুক্তি, জনমুখিতা তুলনারহিত। কথাশিল্পের এক যাদুকরী ভাষা আমরা মিস করি, আমরা সাধারণ মানুষেরা খুঁজে ফিরি স্টপ জেনোসাইডের নির্ভীক মোকাবেলা, সাচ্চা মুক্তির নেশা। ১৯৭১ এর স্বাধীনতার ভিতর দিয়ে কতো বাঘা বাঘা সেলিব্রেটি তাত্ত্বিক পেয়েছি, আগুনখেকো বক্তা আমাদের উপর হামলে পড়েছে- কিন্তু একজন জহির রায়হান, একজন পরীক্ষিত ক্রিয়েটিভ পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল আর পাইনি- অঙ্গীকার আর সৃষ্টিশীলতার এমন যৌগ দ্বিতীয়জন আসেনি আর।
বিপুল মেলা উৎসবের জন্য নরবলি লাগে; জহির রায়হান ছাড়া আর কার এমন বুকের পাটা যে বুক চিতিয়ে খাঁড়ার নিচে মাথা গলিয়ে দিতে পারেন?
জহির রায়হানের দিকে তাকিয়ে আমরা অবলীলায় শতাশতি বাজারী ইন্টেলেকচুয়ালদের খারিজ করি; জহির রায়হানের একটি লাইন ধার করেই বলি- ওদের জানিয়ে দাও। ওরা বুদ্ধিপাইকার।
ফিনকি দিয়ে জহির রায়হানের রক্ত আমাদের তারা-ভেজা চাহনি ও তীরের ফলায় এসে লাগে- ওম গর্ভবতী পাথর কাতরায় শিহরণ লাগি!

কবি, নাট্যকার, অনুবাদক।
কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর।
নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।
প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।
ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।
জালালউদ্দিন রুমির কবিতা, মসনবি : মোরাকাবা ও জলসংগ্রহ।
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।
নাটক : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। পুণ্যাহ। আবের পাঙখা লৈয়া। জুজুবুড়ি। চন্দ্রপুরাণ। পানিবালা। বাঘ। পরীগাঁও। প্রত্ন প্রতিমা। ইলেকশন বাজারজাতকরণ কোম্পানি লিমিটেড। এক যে আছেন দুই হুজুর। পিঁয়াজ কাটার ইতিহাস। ডুফি কীর্তন। নুনমধু টিপসই। পানিফল সংবেদ।।
