চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটির পরে আরেকটি মহৎ উপন্যাসের নাম নিলে নিতে হবে খোয়াবনামা। এটা চিলেকোঠার সেপাইয়ের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। এই দুটো উপন্যাসের লেখকই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তার আগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু আসবে বয়স হিসেবে। তবে চাঁদে অমাবশ্যাই সৈয়দের সেরা কাজ। হুমায়ূন আহমদের অপরাহ্ণ হয়ে ওঠার মধ্যে ছিল। হুমায়ূনের সে ক্ষমতা ছিল। তিনি তার সদব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
হাসান আজিজুল হকের গল্প যে মানে পৌঁছায়–তার আগুন পাখি তার আগে থেমে গেছে। আরেকজন হরিপদ দত্তের অজগরকে আমাদের মনে করা দরকার।
চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের পরে আমাদের অর্জন হতাশাজনক। সস্তা প্রেম, ভাড়ামী আর বিছানা-গল্পের দিকেই উপন্যাসের যাত্রা দেখা যায়। এর মধ্যে যে উপন্যাসগুলোর মধ্যে আলোর ঝলক দেখা গিয়েছে–সেগুলো সূর্য নয়, জোনাকির মিটি মিটি আলো।
তবে এর মধ্যে একটি সূর্যের মত অমিত তেজে যে উপন্যাসটি লেখা হয়েছে এই বাংলাদেশে, , বাংলাদেশের জটিল সামরিক-স্বৈরশাসনের মত মাকড়সা রাজনীতি যা ১৯৫৮ সাল থেকে ভুতের মতো আমাদের অস্তি-মজ্জায় ঢুঁকে বসে আছে, ১৯৭৫ সালের পর থেকে সেই ভুতটি নানা ছদ্মবেশে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাণ ভোমরাকে দখল করে আছে, যার রূপের কখনো রূপান্তর হয় না, অন্ধকার পরিণত হয় তমসায়– যাকে নিয়ে কথা বলার মত দুঃসাহস আমাদের লেখকদের গড়ে ওঠেনি, সেই দূঃসাহসের ফলিত উপন্যাস সাঁজোয়া তলে মুরগা। সামরিক-স্বৈরশাসন, মৌলবাদ, সুবিধাবাধী চীনাপন্থা, পাকিপন্থা, জাতীয়তাবাদের মুখোশশ্রী, আর উভয়-তলীয় মানুষজনদের নিয়ে লিখেছেন আনোয়ার শাহাদাত।
সামরিক শাসিন বিরোধী আখ্যান নিয়ে অসামান্য উপন্যাস এটা। আমার ধারণা, আনোয়ার শাহাদাতের সাজোঁয়া তলে মুরগা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
বাংলাদেশের এই সামরিক-স্বৈরতন্ত্রের লিখিত ইতিহাস যদি কোনো কারণে লুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আনোয়ার শাহাদাতের এই উপন্যাসের মধ্যে থেকে পুনুরুজ্জীবিত হবে। আমাদের বাঁচা মরার উপায় বলে দেবে।
তবে আনোয়ার শাহাদাত ইতিহাস নয়, লিখেছেন মহৎ উপন্যাস। তিনি সেই বিরল গল্পকার-উপন্যাসিক, যিনি একটি বিশেষ ভাষার অধিকারী, যে ভাষাটি কেবল নানা কায়দায় গল্পকে বলায়, যে ভাষায় লিখেছেন শহীদুল জহির, সেই ভাষার আবহে গল্পকথক আনোয়ার শাহাদাত এই উপন্যাসটির মাধ্যমে কালে কালে পঠিত হবেন, পুনরাবিস্কৃত হবেন।
সাঁজোয়া তলে মুরগা উপন্যাসটি পড়ার আমাদের গভীরভাবে বিশ্বাস জন্মে যে ভিক্টর হুগোর হ্যাঞ্চ ব্যাক নতরদাম তুল্য মহৎ কাহিনী লেখার ক্ষমতাধর লেখক আমাদের আছে। এই উপন্যাসই আমাদের লেখা-ব্যর্থতাকে ঢেকে দিতে সক্ষম। নতুন লেখকদের কাছে হয়ে উঠবে পথরেখা।
——-
এখন বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কিন্তু অনুভূত হচ্ছে মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঘরের ভেতর থাকলে টের পাওয়া যায় না। হালকা শার্ট পরে থাকা যায়।
এর মধ্যে শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল বইটি পড়ছি। পড়তে পড়তে ভাবছি, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিয়ে উপন্যাস লিখছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়– শাহজাদা দারাশুকো। অসামান্য বুনন। সৌকর্যময় ভাষা। আর তিনি এমন যাদুকরী ভঙ্গিতে আখ্যান রচনা করেছেন যাতে কখনোই মনে হয়নি আমরা ইতিহাস পড়ছি। আমরা যেন ঘটনাগুলোকে চোখের সামনে ঘটতে দেখছি। যেন আমরা এরকম কোন ঘটনা জানিইই না। ধারণাও করতে পারব না।
আনোয়ার শাহাদাতের সাঁজোয়া তলে মুরগা উপন্যাসটি বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা। কিন্তু তিনি সে সময়কালটাকে বই, নথি থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন।
তার লেখায় মানবিক অভ্যুত্থানের আখ্যানই শুরু থেকে এসেছে। শেষ পর্যন্ত তথ্য বা নথি সাহিত্যের উপর ছড়ি ঘোরাতে পারেনি। আবার ইতিহাস তথ্য বা নথিও অবিকৃত থেকেছে।
একজন গল্পকার ডকুমেন্ট লিখবেন না।ওটা মোহরীর কাজ। তিনি তথ্যের শাসটুকু নিয়ে শুরু এবং শেষ পর্যন্ত গল্পই লিখবেন।
এবং ডকু-ফিকশন বলে কোনো ব্যাপার আসলে হয় না। ওটা সোনার পাথর বাটি মাত্র।
—-+—
অনেক দিন পরে ভারতীয় একটা সিনেমা দেখলাম। নাম–saivam. তামিল ভাষায় নির্মিত। কাহিনী একটি মোরগ নিয়ে। মূল চরিত্র আট বছরের একটি শিশু। আর ৮০ বছরের দাদাজান। অতি সাধারণ একটি বিষয়কে চরিত্র চিত্রণ, দ্বন্দ্ব, টেনশন, ক্লাইম্যাক্স তৈরির মাধ্যমে কীভাবে অসামান্য গল্পে নির্মাণ করা যায় তা এই সিনেমা থেকে সহজে টের পাওয়া যায়। এবং স্বাভাবিক অভিনয় ও গানের চমৎকার ব্যবহার রয়েছে। একটি গান শুনে মনে হল–রবীন্দ্রনাথ এই দক্ষিণী গানের সুর থেকেই সুর আত্মস্থ করে অনেক সার্থক গান রচনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, আনোয়ার শাহাদাত-এর মোরগ নিয়ে একটা উপন্যাস আছে। নাম ‘সাজোঁয়া তলে মুরগা’। একটা মোরগ কেনার পরে একজন সাধারণ মানুষের হাত থেকে সেটি ছুটে যায়। সে সময় সামরিক অভ্যত্থানকারীদের একটা ট্যাঙ্ক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। মোরগটি সেই ট্যাঙ্কের নিচে পড়ে মরে যায়। এরপর ঢাকার মানুষের মধ্যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মে এবং রুখে দাঁড়ায়।
সামরিক শাসিন বিরোধী আখ্যান নিয়ে অসামান্য উপন্যাস এটা। আমার ধারণা, আনোয়ার শাহাদাতের সাজোঁয়া তলে মুরগা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। .
—–
কবে লিখেছিলাম। মনে নেই। তবু মনে পড়ে। এখন নিউ জার্সির উপর দিয়ে যাচ্ছি। যাবো মিশিগান।
যেতে যেতে মনে হয়, বহুদিন এমন কোনো উপন্যাস লেখা হচ্ছে না যা পড়তে পড়তে অক্ষরের গা থেকে ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়বে। ভিজিয়ে দেবে। কচুর পাতার নিচ থেকে উঁকি দেবে একটি শিশুর চোখ। তার দিদির নাকফুলে এখন জল জমেছে।
এই জলের তলা থেকে উঠবে একটি শহর। তার গা সবুজ। আর শ্যাওলার ঘ্রাণ। আর থেকে থেকে কে বা কারা গেয়ে চলে রয়ানি গান।
. . .

কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে তাঁর আদিবাড়ি। বর্তমানে তিনি নিউইর্য়কে বসবাস করছেন। পড়াশুনা করেছেন ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে।
কবিতা দিয়ে লেখালিখির শুরু। একসময় তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন। সেই সময়টাতে শিশুদের জন্যও তিনি বেশ কিছু গল্প লিখেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য লেখালিখিতে বিরতি পড়ে। ২০০৬-৮ এর দিকে ব্লগে লেখালিখি শুরু করেন।
galpopath.com
