রবীন্দ্রনাথ সত্যকে কঠিন বলেছেন। তাহলে কঠিন কেনো? কঠিন এজন্য– সত্যকে চেনা কঠিন। তাকে পাওয়া কঠিন। তাকে ধরা কঠিন। তাকে বোঝা কঠিন। সহজে তার মন মেলে না।
যাকে সত্য বলে মানছি সেটা সত্য নাও হতে পারে। আবার যেটা সত্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে সেটা অন্যের কাছে হতে পারে মিথ্যে। কোন চশমা দিয়ে দেখছি সেটাই আসল। ঠাকুর যেমন বলেছেন, আমারই চেতনায় পান্না হলো সবুজ। আরেকজনের চেতনায় তা লাল হয়ে উঠতে পারে। অন্ধকারে তা হয়ে উঠবে কালো। সত্যের নানা রূপ। বহুরূপী। রূপেশ্বর।
তাহলে সত্য মিথ্যে কোনো ব্যাপার নয়। অন্ততঃপক্ষে একজন মনঃসমীক্ষকের কাছে একদম কোনো ব্যাপারই নয়। তিনি দেখবেন ঘটনাকে। বিবেচনা করে দেখবেন, কী ঘটেছে লোকটির সামনে? আবার যেটা ঘটছে বলে দাবী করা হচ্ছে সেটা তো নাও ঘটতে পারে! যা ঘটেছে সেটা হয়তো ঘটেনি। ঘটেছে অন্য কিছু। সেটা আমরা দেখিনি। দেখছি তার বদলে অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুকে সন্ধান করতে গিয়ে আরো কিছু ঘটনাকে পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে আসলে কোনটি ঘটেছিল– এটা বলা কঠিন। হয়তো এই ঘটনার মধ্যেই সেই আসলটি থাকতে পারে। আবার, নাও থাকতে পারে। হয়তো যেটা ঘটেছিল, ঘটে থাকতে বলে মনে করছি, সেটা আদৌ ঘটেনি। সেটা ছিল বিভ্রম। মায়া মাত্র।
ইতালো কালভিনো বলেন, না, তিনি সত্যকে খুঁজবেন না। সত্যকে লিখবেন না। খুঁজবেন মিথ্যেকে। লিখবেন মিথ্যেকে। মিথ্যেকে লিখতে লিখতে দেখা যাবে মিথ্যে আর নেই। সত্য পড়ে আছে। সত্যকে প্রকাশ করার দরকার নেই। সত্য আপনি প্রকাশ হন।
বের্টল্ট ব্রেশট বলছেন, ব্রাদার হে, তুমি যা দেখছো, তাকে বিশ্বাস করতে যেও না। ওটা বানানো কথা। পচা গপ্পো। কিছু লোক বানিয়ে বানিয়ে তোমাকে হিপনোটাইজ করতে চাইছে। এরা অভিনেতা। নানা রকম মুখোশ পরে আছে। মুখোশ পরে শেখানো বুলি কইছে। তাদের রচিত বিশ্বাসের ফাঁদে তোমাকে ফেলতে চাইছে। সে ফাঁদে তুমি পড়ো না। সে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসো। একটু দূরে যাও। চারিদিকে তাকাও। ভালো করে দেখো। তারপর ভেবে দেখো। ভাবো। ভাবো। যে লোকটি হিটলারের গুণকীর্তন গাইছে আসলে সে লোকটি গোয়েবলস নামের একজন চতুর সুভাষী মিথ্যেবাদী। যে লোকগুলোকে নিরাপদে জীবিত রাখবে বলে ইহুদীদের ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে, সেগুলো আসলে মোটেই নিরাপদ নয়। সেগুলো খুব সহজভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলারই যন্ত্রঘর– গ্যাস চেম্বার, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প।
তাহলে একজন লেখক কী করবেন? তিনি কি হাল ছেড়ে দেবেন? সত্যের পেছনে ছুটবেন না? সত্যকে উন্মোচন করবেন না?
ইতালো কালভিনো বলেন, না, তিনি সত্যকে খুঁজবেন না। সত্যকে লিখবেন না। খুঁজবেন মিথ্যেকে। লিখবেন মিথ্যেকে। মিথ্যেকে লিখতে লিখতে দেখা যাবে মিথ্যে আর নেই। সত্য পড়ে আছে। সত্যকে প্রকাশ করার দরকার নেই। সত্য আপনি প্রকাশ হন।
সত্যকে পেতে হলে মিথ্যেকে লিখুন।
রূপনারাণের কুলে জেগে উঠিলাম,
এই কঠিন সত্যকে ভালোবাসিলাম।

কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে তাঁর আদিবাড়ি। বর্তমানে তিনি নিউইর্য়কে বসবাস করছেন। পড়াশুনা করেছেন ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে।
কবিতা দিয়ে লেখালিখির শুরু। একসময় তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন। সেই সময়টাতে শিশুদের জন্যও তিনি বেশ কিছু গল্প লিখেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য লেখালিখিতে বিরতি পড়ে। ২০০৬-৮ এর দিকে ব্লগে লেখালিখি শুরু করেন।
galpopath.com
