কেন লিখব
নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে মানুষ ব্যক্তি হয়ে উঠতে চায়। অনন্যতা অর্জনের এই কঠিন তপস্যা সেই গুহাযুগ থেকেই চলছে। এই কস্তুরী মানুষ তার রক্তে পৃথিবীর শেষদিন তক বয়ে চলবে। এর অন্যথা দেখি না। প্রজন্মে প্রজন্মে কিছু মানুষ এমনিতেই ভিন্ন ধাতের তৃষ্ণা নিয়ে সংসারে আসে। একান্ত নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নিতে দু-হাতে খুন্তি-কুড়াল চালায়। বুড়ো ঠাকুরের একলা চলার নীতিকে নিজের নিয়তি বলে নিশ্চুপে মেনে নেয়। এতে তাদের একটুও মনস্তাপ থাকে না। অবশ্য আশপাশের অনেকেই এটাকে ভালো চোখে দেখে না। তারা আদর করে এর নাম দেয় ‘কপালের ফের।’ আবার অনেকেই মেলা বুদ্ধি খরচ করে হয়ে উঠে রাজনৈতিক পশু, ঘুষখোর আমলা, ভূমিদস্যু, ঋণখেলাপি, খুনি। তাদের খাতিরে হাটে-বাজারে বক্তৃতা হয়। জোশের বকাবকিতে কখনো কখনো বাচ্চাদের কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে শিশুরা চিৎকার দিয়ে জেগে ওঠে। তখন উন্দাল থেকে মা ছুটে এসে শিশুকে বুকে তুলে নিয়ে গীত জোড়ে, সুর করে ছড়া কাটে, মিষ্টি সুরে গুনগুনিয়ে গান গায়। সুরের ওম ও বুকের নিরাপত্তায় শিশু ফের ঘুমিয়ে পড়ে। তাই লেখালেখি আগের দিনে যেমন চলছিল, পরের দিনগুলিতেও তেমনি চলবে। আপনি-আমি লিখি বা না লিখি।
কী লিখব
প্রসবের সপ্তাহখানেক আগে কোনো কোনো মহিলার চোরা বেদনা ওঠে। কয়েক ঘন্টা পরে বেদনাটা আপনাতেই নাই হয়ে যায়। সতর্ক থাকলে এরকম আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ। আসল বেদনা উঠলে শুধু পোয়াতি নয় আশপড়শিরাও টের পায়। লেখার বেলাতেও এমনটা হামেশাই ঘটে। দড়কচা জীবনে ছোটাছুটির কোনো অন্ত নাই। এর মাঝে আবার লেখার পিছনে ছোটা ! যদ্দুর জানি সোহাগ-কাড়া মেয়ের মতো খাঁটি লেখা নিজেই এসে পেছনে ঘুর ঘুর করে। বারবার মেন টোকা দেয়। একবার তার সুন্দর মুখ দেখায় তো আরেকবার খাউদা খাউদা পিঠ দেখায়। মগজে ভুড়ভুড়ি তোলে। সরতে চায় না। একটু নিফুডি পেলে তার সুখ-দুঃখভরা চিটচিটা ঝোলাটা বগলদাবা করে শিথানে এসে বেজার মনে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘুমটা জমতে দেয় না। কোনো কোনো তরফে দিন-মাস পেরিয়ে বছরের পর বছর লেখাটা পিছে লেগেই থাকে। এই হলো খাঁটি জিনিসি। এটাতে হাত দিলেই সোনা ফলবে।
সহ্য ক্ষমতা
আমার মা প্রায়ই বলতেন,‘যে সয়, সে রয়।’ বিষয় কিংবা আচানক একটা চরিত্রে দুই-একটা বাও পেয়েই টেবিলে খাপ পেতে বসে থাকলে আখেরে ঠকতে হবে। তাই সহ্যগুন বাড়াতে হয়। অবস্থা মাফিক একটু অপেক্ষাও করতে হয়। মনে মনে কত তুলপাড়! কত ভাঙ্গাগড়া! যুক্তি-তর্ক! বুড়ো ঠাকুর বলে গেছেন : ‘যেমন একটা সুতাকে মাঝখানে লইয়া মিছরির কণাগুলো দাঁনা বাঁধিয়া উঠে তেমনি আমাদের মনের মধ্যেও কোনো একটা সূত্র অবলম্বন করিতে পারিলেই অনেকগুলো বিছিন্ন ভাব তাহার চারিদিকে দানা বাঁধিয়া একটা আকৃতিলাভ করিতে চেষ্টা করে।’ তাহলে বলতেই পারি, আমার সন্দেহটা অমূলক নয়। রদ্দি মাল কয়েক বাও দিয়ে দানা বাঁধার আগেই ঝরে পড়ে। তার নাক-মুখ-চোখ-গতরের বর্ণ কিছুই গড়ন নেয় না। তাই লেখার বিষয় ও চরিত্র বাছাইয়ের আগে পোড়-খাওয়া চাষার মতো আমের বোলের সুবাস, রোদ-গরমের কামড় সহ্য করতে হবেই।
কাকে নিয়ে লিখব
একদম হাতের কাছ থেকে চেনা জিনিসটা নিতে হয়। শত ভিড়ের মাঝেও যেন তার গলার আওয়াজ কিংবা মাথার চুল দেখলেই চিনে ফেলা যায়। লোকটা যেভাবে বাঁচে, হাসে, ক্ষেপে গেলে গালি দেয়, অবিকল তার সবটা চাই। কথাসাহিত্যের আসল মাজেজা এখানেই। সে সাধারণকে অসাধারণ করে তোলে, এই লক্ষ্যে কড়ি-বরগা আটকাতে হয় শক্ত শক্ত পেরেক দিয়ে। তার আগে পত্তনের জন্য বাস্তবের ভিটা নিতেই হবে। ওটা না হলে বোশেখ তো দূরে থাক, ফাল্গুনের পয়লা বাওয়ারেই ধপাস করে লুটিয়ে পড়বে সবকিছু।
এখন যে লিখতে বসেছে, সে এর আগে হাজার বার পড়তে বসেছে। তাই সে নিজেও একজন ভালো পাঠক। অন্যের লেখা পড়ে যদি মন মজে, তবে সেটার কী কী ধন-দৌলত আছে তা অবশ্যই চোখে পড়বে। তাই নিজের লেখার গুণেরচে দোষগুলো বেশি বেশি চোখে পড়ার কথা। যদি না পড়ে, তবে নিশ্চয়ই ভেজাল আছে। সেটা হয় পাঠকের মগজে, নয় তো লেখার পরতে পরতে। তাই নিজের লেখার দরদস্তুর সবার আগে নিজেকেই বাজিয়ে নিতে হয়। তা না হলে নিজের অজান্তে বেপারীর চতুর পোলার মতো খরিদ্দারকে সবসময় ওজনে-কম-দেওয়ার অভ্যাস রপ্ত হয়ে যায়।
কতটা লিখব
কার্তিক-অঘ্রাণ মাস এলে পুব দিক থেকে একজন থুত্থুরা বুড়ামানুষ লাঠি ঠুকে ঠুকে আমাদের বাড়িতে এসে উঠত। আমাদের কারো নাম সে ঠিকমতো বলতে পারত না। আমাকে ডাকত উৎফর। বড় ভাইকে ডাকত অজিবর। বড় মায়া ছিল মানুষটার অন্তরে। আমার বড় ভাই-বোনেরা তার কোলে-কাঁখে বড় হয়েছে। আমরা তাকে ‘কটা-দাদা’ ডাকতাম। শুকনার দুই-তিন মাস সে আমাদের পেঁয়াজ-রসুন-তামাক-মরিচ ক্ষেতের তালাফি করত। লোকটা ছেনি দিয়ে ক্ষেতের মাটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সামনে এগোত আর পেছনে পেছনে মরিচ-রসুনের চারা ঘঁষটে, মাটি হিঁচড়ে যেত তার বিরাট দুটো অণ্ডকোশ। আমরা শিশুরা ফাঁক পেলেই পিছন থেকে তা মুঠি দিয়ে ধরতাম। বুড়ো বলতো, ‘ছাইড়া দ্যা, এইডার ঘষা না খাইলে মরিচ গাছ বড় অইব না, ফুল ধরব না।’ সেই দাদা মাঝে মাঝে জোয়ান কামলাদের সাথে তর্ক করার সময় বলত : ‘কথা কওয়ার দাম যুদিন এক ট্যাহা অয়, তে কথা না-কওয়ার দাম দুই ট্যাহা।’ গল্পের আরেকটা মাজেজা এর মাঝেই গুপ্ত আছে। শব্দের মোহ, চারিত্রের প্রতি পক্ষপাত, পাঠকের মন মজানোর লোভ সব কাটায়া শিবের মতো নির্মোহ না হতে পারলে তামাম আয়োজন মাটি হয়ে যায়। কথাসাহিত্যের ভাব, বাক্য ও ভাষাকে লক্ষ্যভেদী করে তোলা চাই। সে জন্য টান টান করে বাক্য বাঁধতে হয়। শব্দ বাছাই ও উপমার গালা লাগাতে মাটির পাতিল বাজিয়ে খরিদ করারা মতো অভ্যাস করতে হয়। এই ভাবে ছোট গল্পের গতর-গড়ন-অন্তঃকরণ অনেকটা কবিতার মতো। সে জন্য কথাসাহিত্যের গিন্নিপনায় কবিতার চেষ্টা-চরিত্র থাকলে আরও ভালো হয়। তাই আরেকবার মনে করা যাক : ‘কথা বলার দাম এক টাকা হলে জাগামতো কথা না বলার দাম দুই টাকা।’
লেখার কৌশল
দর্জি যেমন সুতার মাথাটা জাগামতো টেনে ধরে, তেমনি মনমতো বিষয় ও চরিত্র ধরতে পারলে সে-ই ভাব, ভাষা-আঙ্গিক জোগাবে, শালিখের মতো খুঁটে খুঁটে ওজনমাফিক শব্দ বেছে দেবে। তখন চরিত্র নিজেই বাঁকে বাঁকে শক্তিমান মরদের মতো একলাই ডাকাডাকি করে দশজন জড়ো করবে, পথ-ঘাটের দিশা দিবে, নিজেই টেনে টেনে সময় মতো বন্দরে পৌঁছে দেবে। লেখার কৌশল বা ক্রাফট, এই সব আলাপ একিনে ঠাঁই না দিলেও হাল ও দাঁড়ের মাঝিরা বেসাতে ঘাটতি খাওয়াবে না।
সময়ের এজমালি বৈঠকখানা
একখানা নজির দিয়ে শুরু করা যাক;
‘ভালো ওয়ার্ডার, সদাশয় ওয়ার্ডার,’ আমি বললুম।‘আজ সকালে দারোগাসাহেব বলছিলেন গান্ধিজি নাকি মৃত্যুশয্যায়। তুমি এ-সমন্ধে কিছু শুনেচো, ওয়ার্ডার সাহেব?
‘উনি অনশন ভঙ্গ করে লেবুর রস খেয়েছেন।’
অতি উত্তম। মোহনদাস গান্ধি দীর্ঘজীবী হোন।
একের পর এক লোহার দরজা পেরিয়ে আমরা হেঁটে চললুম।
আমি জিজ্ঞেস করলুম : ‘এখন এখানে কতজন রাজনৈতিক বন্দি আছে?’
‘তুমি যেখানে যাচ্ছো, সেখানে সবশুদ্ধু সতেরোজন আছে।’
[‘দেয়াল’ : ভৈকম মুহম্মদ বশীর]
একেবারে চোখ বন্ধ করে বলা যায়, ভৈকম সাহেব কলমের কয়েকটা খোঁচায় সময়, প্রতিবেশ আর চরিত্রের রসায়নে কী অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়েছেন ! এবার দেখা যাক কথাসাহিত্যে সময় ও চরিত্রের চারপাশ বিষয়ে বুড়ো ঠাকুরের মতামত কী:
‘বস্তুজগতেও ঠিক জিনিসটি ঠিক জায়গায় যখন আসর জমাইয়া বসে তখন চারিদিকের আনুকূল্য পাইয়া টিকিয়া যায়, এও ঠিক তেমনি। অতএব যে বস্তুটা টিকিয়া আছে সে যে কেবল নিজের পরিচয় দেয় তাহা নয়, সে তার চার দিকের পরিচয় দেয় ; কারণ সে কেবল নিজের গুনে নহে, চারদিকের গুনে টিকিয়া থাকে।’
[সাহিত্যসৃষ্টি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
নিশ্চয়ই এবার পরিষ্কার : ‘যে বেটি রাঁধে, সেই বেটি চুলও বাঁধে।’ তাই শুধু চরিত্রকে ভাব-ভাষা-আঙ্গিক ও বাস্তবতার মোড়কে কষে বাঁধলে চলে না। ফাঁক মতো দুই-এক টানে সময় ও চারপাশের খুঁটি-নাটি দিয়ে ঝানু কামারের মতো শান দিতে হয়।
খাঁটি ওস্তাদ আগে ভূত সামলায়
বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। পাঠক এক আজব জিনিস। এই জিনিসের রসনার কূলকিনারা নাই, সুরাহা নাই। কারণ পাঠক যখন ঠকতে শুরু করে তখন সে আর পাঠক থাকে না। ভূতের মতো আপদ হয়ে দাঁড়ায়। তাই পয়লা সবকেই ঠকাঠকির হিসাবটা শক্ত হাতে মিটিয়ে ফেলতে হবে। প্রথম বাক্য কিংবা প্রথম প্যারাতেই ভরে দিতে হবে আদত জিনিসের একটা চিক্কন ইশারা। এখানে ওজনে বাটপারি করলে কিছুতেই আর ভাঙন রোধ করা যাবে না। না চাইলেও শুরু হবে ঘ্যানর ঘ্যানর। গ্রামে ভূতে-আছর করা মানুষ প্রায়ই দেখা যায়। দিনমার বিড়বিড় করে আর হাঁটে। এই ধরনের কথা বলাকে গ্রামের মানুষ ‘বগর বগর’ বলে। কেউ কেউ বলে ‘জ্বরের প্যাচাল।’ জ্বরের প্যাচাল মনে রাখা তো দূরে থাক কেউ শুনেও না।
যে পড়ে সেই লেখে
এখন যে লিখতে বসেছে, সে এর আগে হাজার বার পড়তে বসেছে। তাই সে নিজেও একজন ভালো পাঠক। অন্যের লেখা পড়ে যদি মন মজে, তবে সেটার কী কী ধন-দৌলত আছে তা অবশ্যই চোখে পড়বে। তাই নিজের লেখার গুণেরচে দোষগুলো বেশি বেশি চোখে পড়ার কথা। যদি না পড়ে, তবে নিশ্চয়ই ভেজাল আছে। সেটা হয় পাঠকের মগজে, নয় তো লেখার পরতে পরতে। তাই নিজের লেখার দরদস্তুর সবার আগে নিজেকেই বাজিয়ে নিতে হয়। তা না হলে নিজের অজান্তে বেপারীর চতুর পোলার মতো খরিদ্দারকে সবসময় ওজনে-কম-দেওয়ার অভ্যাস রপ্ত হয়ে যায়।
লেখালেখিতে শিষ্য আছে, গুরু নাই
লিখতে বসলে নিজেকেই গুরু মানতে হয়। তখন মনে আসতেই পারে,‘এই মুহূর্তে লিখিত হচ্ছে বিশ্বসাহিত্যের সেরা ক্লাসিক।’ তরুণের এই অহংবোধ ও বিশ্বাস যদি না থাকে তবে সজিনা ডালের মতো মাঝপথেই কড়াৎ করে ভেঙে-পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দশ মিনিট আগে টেবিলে যে কালোত্তীর্ণ বইখানা ছিল, মগ্ন পাঠকের হৃদয়জুড়ে যে লেখক জেঁকে বসেছিলেন, লিখতে শুরু করার পর নিজের ছায়াতে তার কায়া চাপা দেওয়াই সবচে নিরাপদ। গুরু পাঠকের থাকতে পারে কিন্তু লেখকের না-থাকাই স্বাস্থকর। কারণ কে না জানে লেখালেখিতে গুরুর জন্য নখপরিমান জমিন বরাদ্দ নাই। ওটা বিশ্বাস করলে জ্যান্ত ডুবতে হয়। আর পাঠকের কাছে যারা গুরু বনে গেছেন তারা এই জন্য গুরু যে, তাদের চিন্তা জীবনজগতে প্রায় চিরন্তনের কাছাকাছি। এবার তাহলে নিজের লেখাটাতে চোখ ফেরাতে হয়। যে যে কারণে তাঁরা চিরন্তনের কাছাকাছি তার দুই-এক ফোটা নিজের লেখাটাতে আছে কি ?
…

জন্ম : জয়ধরখালী, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ।
গল্পের বই : উল্টারথে- ২০০৮, ভাতবউ- ২০১৩, অসুখ ও টিকনের ঘরগিরস্তি ২০১৭, ফলের নামটি ভুবননটী, ২০২৩।
উপন্যাস : আত্মজীবনের দিবারাত্রি- ২০১১, রাজকুমারী- ২০১৯, চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ- ২০২৪।
কিশোর উপন্যাস : সুতিয়া নদীর বাঁকে, ক্লাস অভ ভুত, সুমাভূতের কাণ্ড।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস: কালো মাটির নিঃশ্বাস।
