Monday, December 22, 2025
Homeসবিশেষগল্পখোঁজ | দিনা ফেরদৌস

খোঁজ | দিনা ফেরদৌস

বিয়ের তিনদিন আগে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে রূপা। চোখের নিচে পড়ে কালো দাগ। ঠিকমতো খেতে না পেরে শরীর হয়ে যায় রোগা। কিছু খেলেই বমি হয়। তিনদিন ধরে চোখে ঘুম নেই। ঘুমালেই সেই একি স্বপ্ন। লাল চুনরি ওড়নায় মুখ ঢেকে এক নারী রূপার বুকের উপর বসে দুই হাত দিয়ে তার গলা চেপে ধরে বলছে; ‘বিয়েটা বাতিল কর।’

ভয়ংকর স্বপ্নের কথা বাসার কাউকে না বললেও প্রিয় বান্ধবী তৃণাকে সে বলেছে। তৃণা হচ্ছে, রূপার ছোটবেলার বান্ধবী। একসাথে একি স্কুল, কলেজে পড়েছে। স্কুল-কলেজের নোট বই থেকে শুরু করে, জামা, জুয়েলারি, সবই তারা ভাগাভাগি করত। তৃণা রূপাকে একটু আলাদাভাবে দেখত। বলত, তুই আমার বোন।

রূপার স্বপ্নের কথা শুনে তৃণা হো হো করে হেসে বলেছিল- ‘মনে হয় কোনো জ্বিন তোর প্রেমে পড়েছে। তোকে বিয়ে করতে চায়। খরব আছে কিন্তু।’

রূপার শরীর প্রতিদিন খারাপের দিকেই যেতে থাকে। পাশাপাশি শুরু হয় প্রতিদিন একটা না একটা অঘটন। দুইদিন আগে রূপার অতি পছন্দ করে বানানো গতবারের ঈদের জামাটা হারিয়ে গেলো। তার পরের দিন ঘুম থেকে উঠে সে দেখে মাথার এক জায়গা খালি। কোনো চুল নেই সেখানে। দেখলে মনে হয় কেউ তার কয়েক ইঞ্চি চুল খাবলে তুলে নিয়ে গেছে। এদিকে বিয়ের দিন সকালে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কেনা রূপার দুই ডজন লাল রেশমি চুড়ি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রূপা চমকে ওঠে। তার হারিয়ে যাওয়া চুড়িগুলো তৃণার হাতে। তৃণা পরে আছে সেই লাল চুনরি ওড়নাটা, তৃণার সারা মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল আর তার মুখে আগে যে কালো দাগগুলো ছিল সেগুলো এখন নেই। তৃণা যখন কথা বলে ওঠে, তখনই তার মনে পড়ে যায়, বাসররাতে শোনা সেই ভূতের গলাটা ছিল তৃণার।

মা’কে একবার বলেও ফেলেছে রূপা, এই বিয়েটা তার জীবনে কুফা হয়ে এসেছে। বাদ দিলেই তার ভালো হবে। মা বলেছেন বিয়ে ঠিক হলে অনেক মেয়েদেরই এমন হতে পারে টেনশনে। রূপাকে এইসব নিয়ে ভাবতে হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর সামান্য কয়টা চুড়ির জন্য বিয়ে বাতিল করার কোনো মানে হয় না। বিয়ে বাড়িতে এমন ঘটনা নতুন কিছু না।

রূপার শরীর খারাপের সংবাদ শুনে হবু বর মিজান রূপাকে একদিন দেখতেও এসেছে। বলেছে, বিয়ের ভয়ে তারও কয়দিন থেকে নাকি জ্বর জ্বর করে। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত দুজনের কারোই মনে হয় শরীর ভালো হবার আর কোন চান্স নেই।

বিয়ের রাতে রূপা যখন মিজানের জন্যে বাসরঘরে অপেক্ষা করছিল, তখন শুনতে পায় খাটের নিচে কেউ যেন হাঁপাচ্ছে। প্রথমে তার মনে হয় আগের যুগে বরের বাড়ির লোকজন বাসরঘরের খাটের নিচে লুকিয়ে থাকত মজা দেখার আশায়, সে রকম কেউ মজা করতে চাচ্ছে। কিন্তু মিজানের পরিবার তো এমন হওয়ার কথা না। তবুও বিষয়টা বলার জন্য সে যখন মিজানকে ফোন করতে যায় তখন দেখে ছায়ার মতো একটা মেয়ের হাত ধীরে ধীরে তার বিছানার নিচ থেকে উঠে আসছে। সেই হাতটায় তার হারিয়ে যাওয়া চুড়িগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রূপা ফোনও করতে পারে না, চিৎকারও করতে পারে না। ভয়ে গুটিয়ে থাকে।

হাতটা কতক্ষণ তার চোখের সামনে চুড়িগুলো নাচায়। একটু হাসে। তারপর পরিষ্কার গলায় খাটের নিচ থেকে কেউ বলে ওঠে- না করলাম। তবুও তুই বিয়েটা করে ফেললি? ঠিক আছে। দেখা যাবে।

গলাটা রূপার কাছে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না গলাটা কার।

মিজানকে আর ঘটনাটা বলেনি সে। কিন্তু নিজের একটা স্যান্ডেল খাটের নিচে ঠেলে দিয়ে যখন খোঁজাখুজি শুরু করে। মিজান নিজে থেকেই খাটের নিচ থেকে স্যান্ডেলটা বের করে দেয়। সেখানে কেউ থাকলে নিশ্চয়ই মিজান তাকে দেখত। কিন্তু সেখানে কেউ নেই…

বিয়ের পরের দিন সকালে বাথরুমের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে ওঠে রূপা। তার সারা মুখে হালকা ছোপ ছোপ দাগ। বেডরুমে ফিরে চুল আঁচাড়তে গিয়ে দেখে মুঠো মুঠো চুল উঠে আসছে চিরুনির সাথে।

দুপুরে তৃণা ফোন করে। জানতে চায় প্রথম রাত কেমন কাটল। তৃণার কন্ঠে ছিল অদ্ভুত মিষ্টতা।

দিনে দিনে রূপার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। মুখের ছোপছোপ দাগগুলো আরো গাঢ় কালো হয়ে ওঠে। তার সারা মাথা জোড়া কোঁকড়নো চুল ঝরে ফাঁকা হয়ে যায়।

অনেক ডাক্তার দেখানো হয় কিন্তু রোগ ধরা পড়ে না। রূপা গর্ভ ধারণ করার পরে প্রতিরতেই স্বপ্নে দেখত লাল চুনরি ওড়নায় মুখ ঢাকা সেই নারী তারই চুড়িগুলো দুই হাতে পরে তালে তালে তার তলপেটে ঘুষি মারছে।

প্রতিরাতেই চিৎকার করে রূপা জেগে উঠত। মিজানকে ডেকে তুলত। লাইট জ্বালিয়ে ঘর চেক করতে বলত। কিন্তু মিজান কোনোদিনও ঘরের ভেতরে তারা দুইজন ছাড়া অন্য কাউকে খুঁজে পায়নি।

রূপার গর্ভ বাড়ে। কিন্তু বাচ্চাটা টেকে না।

বছর যায়। রূপার শরীর কিছুটা ভালো হয়। তার একটা মেয়ে জন্ম নেয়। মেয়ের প্রথম জন্মদিনের পর হঠাৎ একদিন কোথায় যেন হারিয়ে যায় মিজান। থানা পুলিশ খোঁজাখুঁজি করেও মিজানের কোনো সন্ধান করতে পারে না কেউ। এতদিন তৃণার সাথেও রূপার আর কোনো যোগাযোগ হয়ে উঠে না। শুনেছে তৃণা বিয়ে করেছে।

মেয়ের দ্বিতীয় জন্মদিনের আগে হঠাৎ করেই রূপা গিয়ে হাজির হয় তৃণার বাসায়।

রূপা চমকে ওঠে। তার হারিয়ে যাওয়া চুড়িগুলো তৃণার হাতে। তৃণা পরে আছে সেই লাল চুনরি ওড়নাটা, তৃণার সারা মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল আর তার মুখে আগে যে কালো দাগগুলো ছিল সেগুলো এখন নেই। তৃণা যখন কথা বলে ওঠে, তখনই তার মনে পড়ে যায়, বাসররাতে শোনা সেই ভূতের গলাটা ছিল তৃণার।

রূপা হা করে তৃণাকে দেখতে থাকে। তৃণা তার বরকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়- মৃদুল।

এইবার রূপা একেবারে পাথর বনে যায়। এতো মৃদুল না; এই মানুষ তার বর মিজান।

দিনা ফেরদৌস
দিনা ফেরদৌস
লেখালেখি করেন নারীদের অধিকার, নারীর সংকট এবং নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য নিয়ে। তার লেখালেখির মূল ক্ষেত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ, বিভিন্ন সাময়িকী, নিউজ পোর্টাল এবং প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা। সমসাময়িক বিষয়ের উপর কলাম ও ছোটগল্প লেখা দিনার অন্যতম প্রিয় লেখার বিষয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সক্রিয় দিনার ব্যক্তিগত পছন্দের মধ্যে রয়েছে ছবি আঁকা, বই পড়া, আবৃত্তি করা। পড়াশোনা হচ্ছে আইন বিষয়ে স্নাতক। বাড়ি সিলেটে।
এইরকম আরও পোস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
ad place