Tuesday, December 23, 2025
Homeঅন্যভাষামুসাফির শিহরণগুচ্ছ ।    বদরুজ্জামান  আলমগীর

মুসাফির শিহরণগুচ্ছ ।    বদরুজ্জামান  আলমগীর

রাইনের মারিয়া রিলকে

অন্ধ মেয়েটি যেভাবে বেড়ে ওঠে

মেয়েটি, আমাদের সবার মতো চা নিয়ে বসেছিল
একবার মনে হলো, সে কাপটি উপরে তুলে ধরে;
অন্য সবার থেকে কোথায় যেন ওর কাপ ধরার ভঙ্গি
খানিকটা আলাদা।

সে হাসে — তার হাসি বুকের মধ্যে একচিলতে ব্যথা
বুঝি গড়িয়ে পড়ে।

একপর্যায়ে আমরা সকলে কথায়, হুল্লোড়ে মেতে উঠি
সবগুলো ঘর সৌজন্যে সাফল্যে হর্ষের সজীবতায় থৈথৈ করে;
আমি দেখি, মেয়েটিও সবার সাথেসাথেই আছে,
সবার পিছনে —  উচ্ছ্বাসের রেশ ধরে সবার সঙ্গে শরীক!

ওকে মনে হলো — বেশ ধীরস্থির, সাবধানী, কিছুটা বিচলিত ;
অনেকটা ওইরকম : যার কী-না একটু পরেই
ঘরভর্তি লোকের সামনে গান গাইতে হবে;

তার চোখ উল্লাসে চকচক করে উঠবে,
সেখানে জমবে না একফোঁটাও মনের ভার— বরং ঝলমল
করতে হবে আঁখি পল্লব,
সাঁতার কাটার পুকুরে যেমন বাইরে থেকে ঠিকরে পড়ে রোদ!

খুব হিসেবী ধীর পায়ে সে ভিড়ের পিছন পিছন সেঁটে থাকে—
ভীরু, বিহŸল, কিছুটা লাজুক।
মনে হচ্ছিল,তার সামনে এখনও এক বোঝাপড়া
বাকি পড়ে আছে:

তাকে একটা উঁচু ঢিবি, কী একটা খাড়া ব্রিজ টপকাতে হবে!
তার মধ্যে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা, প্রস্তুতি জমাট বাঁধে:
যে-ই না পার হয়ে যাবে— তাকে আর পায় কোথা!

সে আর হেঁটে যাবে না, মোটেও হাঁটবে না আর
উড়ে যাবে বাকিটা পথ— উড়াল দিয়ে যাবে!

ইংরেজি ভাষান্তর : মারগারেট মুনস্টারবার্গ। Rainer Maria Rilke: Growing Blind

মৃত্যু

আমাদের সামনে মহীয়ান মৃত্যু জাগরুক
আমাদের নিয়তি তার ঠাণ্ডা হাতের নিচে নিয়ত হাজির।

আমরা যেই না জীবনের সম্ভ্রম পান করতে
লাল দ্রাক্ষারস উপরে তুলে ধরি
মরমী পানপাত্র বেজে ওঠে গরিয়সী টঙ্কারে
আর একমোচড়ে আনন্দ ছলকায়—

জীবনের চুমুকের নিচে মৃত্যু তার শির নমিত করে
আর আমাদের পাশ ঘেঁষে কাঁদে!

ইংরেজি ভাষান্তর : জেসি লেমন্ট। Rainer Maria Rilke : Death

রাইনের মারিয়া রিলকে: ডিসেম্বর ৪, ১৮৭৫ —ডিসেম্বর ২৯, ১৯২৬; ভাবতেন দুনিয়ার এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি ঘোরাঘুরি আসলে দূরত্বকে পায়ের ফিতায় মাপা বৈ-তো নয়, আসল পরিভ্রমণ ঘটে নিজের ভিতর মুসাফিরির ভিতরানা দিয়ে। রিলকে শুরু করেন অতিশয় এক সহজ সূত্রানুভ‚তি থেকে— যা ছিল জার্মান লোকসঙ্গীতের ব্যাকুল সুরধ্বনি; যদিও তিনি জন্মেছিলেন প্রাগে কিন্তু পরিবার ছিল জার্মান ভাষাভাষী। আমাদের এখানে প্রথমদিকে জীবনানন্দ দাশের মধ্যে যেমন কাজী নজরুলের প্রতিধ্বনি ছিল, রিলকের কাজেও ছিল হাইনরিশ হাইনের প্রভাব। ক্রমান্বয়ে তিনি একটি জটিল ও নিজস্ব কাব্যনিরিখ গড়ে তুলতে সক্ষম হন: তারজন্য তিনি আশ্রয় করেন জীবনের অভিঘাত ও কল্লোলের কাছে; না ঈশ্বর, না বাইবেল, না শিল্পের প্রথাসিদ্ধ পথ— রাইনের মারিয়া রিলকে দক্ষ শিল্পমেস্তরীর অভিনিবেশে গড়ে তোলেন এক প্রাতিস্বিক যাত্রা পথ— যার নাম পরিশেষে দাঁড়ায় এক্সিসটেনশিয়াল ম্যাটেরিয়ালিজম: জীবনমুখী বস্তুবাদ। গদ্যময় জীবনের পদ্য, কর্কশ সময়ের সঙ্গীত অন্বেষা-ই রাইনের মারিয়া রিলকেকে বিশিষ্ট করে তোলে।

আলেক্সান্ডার পুশকিন

জর্জিয়ার পাহাড়

জর্জিয়ার পাহাড় রাত্রির অবগুণ্ঠনে ঢাকা
পাথরের মৌনতার নিচে ধীরে বহে আরগভা নদী
আমার হৃদয় কোমলাভা ব্যথা মর্মর,
বেদনার কী-যে প্রসন্ন বিভা!

আমার ভাঙন করে ধারণ— সবটুকু তোমার স্মরণ।
ধূসরিমা— আদিগন্ত তোমা থেকে আসা বিপন্ন বিস্ময়
বাধা মানে না; আমার হিয়া না শোনে বারণ।

তোমার লাগি ছিন্ন হৃদয় নিঃসঙ্গ— বড়ই তুমুল একা
তোমার পরশ ছাড়া আমার এ-প্রাণ উদ্বাস্তু, বসতিহীন
কাঁপে তৃষ্ণার শিখা।

ইংরেজি ভাষান্তর : ইভগেনি বনভার। Alexander Pushkin :

তোমারে মন দিছিলাম

আমি তোমার লাগি সত্যের পাগল হইছিলাম,
তোমার কাছে মন থুইছিলাম আমানত।
তোমার নেশায় এখনো আমি রাতদিন ফানা
কতো যে বোঝাই মন তো মানে না মানা।
তোমারে দেখলেই বেবাক যাইতাম ভুইলা
মন ফিলা করতে চাই না পুরান কথা তুইলা।

শোন তোমারে জায়গা দিছিলাম আমার ক্বলবে
চোখ বুঁজলেই ভ‚মিকম্প লাগতো তিরাসে পরবে।
জোরে ডাকি নাই যদি তোমার ঘুম ভাইঙ্গা যায়
খাদে ছিলাম ধরমু তোমায় পড়লে অবেলায়।

দোয়া করি দক্ষিণ দুয়ারে এক বেজান সাধু আসুক
ধনী হও জনী হও আঞ্চলে বান্ধিয়া তোমার মাসুক।।

Alexander Pushkin : I loved you

আলেক্সান্ডার পুশকিন প্রচণ্ডপ্রতাপ জারের আমলে ২৬শে মে ১৭৯৯ সনে রাশিয়ার মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মগতভাবে পুশকিনের আচরণ ও রক্তে খানদান ও সম্ভ্রান্তির তকমা লাগানো ছিল। পুশকিনের মা নাদেজডা ওসিপোভনা গ্যানিবল ছিলেন এবিসিনিয়ান রাজার নাতনি। তিনি একেবারে শৈশবকাল থেকে, এমনকী শিশু বিদ্যানিকেতন জারসকো সেলো— তে পড়াকালীন প্রথম কবিতা লেখেন। কবিতার বাইরে পুশকিন ছোটগল্প, নাটক ও উপন্যাসও লেখেন। সব বড় কবির মতোই আলেক্সান্ডার পুশকিন প্রচলিত প্রথা আর অভ্যাসকে অপছন্দ করার মহতী দুর্ভাগ্য সঙ্গে নিয়ে বড় হতে থাকেন। অপছন্দ করার রোগ, কী ব্যাধি যখন ওই সময়ে কবিতায় বা শিল্পের অন্য কোন মাধ্যমে অভিব্যক্ত  হতো তাকে ধরতাই কথায় বলা হতো রোম্যান্টিকতা। পুশকিনের চিন্তা ও লেখায় গভীর প্রত্যয়ে রোম্যান্টিকতার বীজানু দানা বেঁধে ওঠে: তাঁর রোম্যান্টিকতা প্রেম ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রশ্নে ছিল থরোথরো, বাক্সময় ও চন্দ্রাহত। আলেক্সান্ডার পুশকিন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পচৈতন্যের উদ্ভাসে এতোটাই লিপ্ত এবং নিরাপোষ ছিলেন যে,  তিনি তাঁর স্ত্রী ন্যাতালিয়া নিকোলায়েভনা পুশকিনার অপবাদ ঘোছানোর কঠিন সময়ে কবির ভীরুতায় পিছপা হন নি, বরং সাহসী যোদ্ধার ক্ষিপ্রতায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন— সেখানে গুরুতর আহত হয়ে ২৯শে জানুয়ারি ১৮৩৭ সনে সেইন্ট পিটার্সবুর্গে মৃত্যুবরণ করেন।

এমিলি ডিকিনসন

সত্য কহো রয়েসয়ে বলো

সবটুকু সত্য বলো—
কহো পরোক্ষে।
সত্য কাজ করে
যদি রয়েসয়ে বলো।
চাঁচাছোলা সত্য
আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
বাচ্চারা ঝলসে দেওয়া বিজলি
সইতে পারে না।
বলা হোক, আসুক ক্রমশ—
এক দঙ্গলে সত্য নামলে
তার ঝাঁজে
মানুষ কানা হয়ে যাবে।

Emily Dickinson : Tell the truth but tell it slant

আমি মাছির গুঞ্জন শুনেছিলাম

আমি যখন শেষবারের মত চোখ বুজি
শুনি চারদিকে মাছি ওড়ে, ঘোরে ভনভন।
ছোট ঘর নৈঃশব্দ্যে থমথম, বাইরের বাতাসে নীরাগ;
ঝড়ো তাÐবের মাঝে এক ফোকর নীরবতা—

ঘরে ঠাসাঠাসি হৃদজনের চোখে নিরাশা—
বুকের ভিতর জমতে থাকে ভারী শ্বাস,
উদ্বেগে নিরাশ্রয় জোড়াজোড়া চোখ—
কখন এ-ছোট্ট ঘর থরথরিয়ে কেঁপে উঠবে
নিরঙ্কুশ রাজার পদভারে—

আমার যে সব দিতে হবে সে-তো আমি জানি
পথ চেয়ে নিজের সবটুকু অঞ্জলি করেছি সমর্পণ—
পসরা হাতে আমি একপায়ে খাড়া
কোত্থেকে এলো এক যাত্রাভঙ্গের মাছি!

আমি ও আমার মাঝখানে দ্বিধার পর্দা
অন্ধকারে ভেঙে পড়ে আলোর সাঁকো—
আমার সব দেখা অধিগ্রহণ করে
অদেখার পাষাণ!

Emily dickinson : I heard a fly buzz when I died.

মৃত্যুর বৈশম্পায়ন এমিলি ডিকিনসন; আড়ি পেতেছেন মৃত্যুর সাথে, হাড্ডাহাড্ডি লড়েছেন মৃত্যুরই বাজি খেলার সনে। ক্ষরিত জোছনার অঙ্গনে করুণ, আবার একইসঙ্গে দোধারী ধারালো তলোয়ারের নিঃসঙ্গ তীব্রতায় বুনেছেন কবিতার থরোথরো ধ্যানবিন্দু। এতোটাই তিনি ভাঙন গরীয়সী যে, কবিতার ছত্রগুলোও ভাঙাভাঙা পারদের দানা— লাইন পুরোপুরি শেষ হয় না; হাহাকারে বুঝি কবিতার স্তবক ছত্রখান ছড়িয়ে পড়ে। ডিকিনসন তাঁর অর্জন, শিখরস্পর্শিতা নিজে দেখে যেতে পারেন নি। জীবদ্দশায় গোটা ১২ কবিতা বেরিয়েছিল, সাকল্যে ১৮০০-এর মত কবিতার সবই বেরোয় তাঁর জীবনাবসানের পর। তাঁর বিষন্নতা ও মৃত্যুরঙের অভিজ্ঞান কবিতাপরম্পরায়, বিশেষকরে নারীবাদী চারুশিল্পে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখে।

এমিলি ডিকিনসন জন্মেছিলেন এমহার্স্ট, ম্যাচাসুসেটসে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ, ১৮৩০ সনে, মৃত্যুবরণ করেন নিজ শহরেই ১৫ মে, ১৮৮৬ সনে।

জালালউদ্দিন রুমি

অদৃশ্যকে দেখার উড়াল

অবশেষে তুমি অদৃশ্যকে দেখতে উড়াল দিয়েছো।

তুমি এই জগৎ থেকে ওই দুনিয়ায় যেতে
কোন আচানক পথে পাড়ি দাও?

পালকের পর পালক খসিয়ে ডানা ঝাপটে
খাঁচা ভেঙে পাখি শূন্যের বাড়ি—
আকাশের ওপারে আকাশে মিলাও।

এবার তুমি একাত্ম হও আত্মাদের দুনিয়ায়।

তুমি এক বুড়ির ছলাকলায় বন্দী ছিলে
বুঝি এক বাজপাখি।

তুমি অকস্মাৎ শুনতে পাও অসীমের টঙ্কার—
উড়ে যাও সময় ও অন্তরীক্ষের ওপারে।

তুমি সঙ্গকাতর, তাই পাখা মেলাও পেঁচাদের সাথে
উড়ে উড়ে তোমার বোধে আসে গোলাপ বাগান।

উন্মাতাল তুমি— পেঁচাদের থেকে আলাদা হয়ে পড়ো
একাকিত্বের জৌলুসে দলছুট ঘুরে যাও,
এবার এসে মেশো তুমি গোলাপের সনে।

এ মায়া দুনিয়ায় তুমি নেশায় বুঁদ হয়েছিলে
শোরগোলে তোমার মাথা ঝিমঝিম করছিলো!

অবশেষে তুমি অনন্তের জারণখানায় মিলনবাড়ি আসো।

ঠিক যেন ধনুক থেকে ছিটকে আসে তীরের ফলা
আর লক্ষ্যভেদী ছুটে যাও মূল বিন্দুর দিকে।

রংতামাশার দুনিয়া তোমাকে অনেক মেকি নিশানা দেখিয়েছে
তবু তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে পারে নি,
তুমি ঠিকঠিক এসে নোঙর করো সত্যের উৎস ঠিকানায়।

তুমি এখন নিজেই সূর্য,
মাথার তাজ হতে আর কী চাই তোমার?

তুমি এই জাগতিক জগৎ থেকে আলাদা হয়ে গ্যাছো,
এখন অন্তহীন বিস্তার,
কে আর তোমাকে ক্ষীণতায় বাঁধতে পারে?

তুমি যদি তোমার আত্মার সাক্ষাৎ চাও—
শত আয়োজনে আশায় কিঞ্চিৎ তার দেখা পাও বড়জোর।
অংশবিশেষে আর তোমার মন ভরে না—
যখন তুমি নিজেই সামগ্রিক আত্মায় রূপান্তরিত হয়ে গ্যাছো।

আমার প্রাণ, তুমি কী যে এক কীর্তিমান পাখি—
অবিরাম খোঁজ করো অনিঃশেষ সত্যের মোকাম;
পাখা ঝাপটাও, শত্রুর তীব্র তীর তোমাকে জখম
করতে পারে না।

প্রকৃতির বৈরিতার মুখে পুষ্প নিজেকে আড়ালে
লুকিয়ে ফেলে,
অথচ তুমি এমন এক গোলাপ—
শীতের বরফ প্রতিক‚ল তোমাকে হারাতে পারে না—
তুমি অনুক‚ল ফুটে রও!

তুমি বেহেস্তের নেকদার বৃষ্টির ফোঁটা
এই দুনিয়ার টিনের চালে ঝরে পড়ো অফুরান।
কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারে না,
জলের গলানের সাথে আবার কল্লোলে হারিয়ে যাও।

এতোদিনে কথার ফেনা মিশে গ্যাছে নীরবতায়।

দুঃখ— যে এসেছিল প্রগলভতার কেশরে চেপে
তা-ও অন্তর্হিত— অন্তর্হিত।

তুমি এখন প্রিয়তম সখার যত্নশীল হাতের অধীন—
হিয়ার অনুক‚ল আত্মায় বিস্তার লাভ করো।।

ইংরেজি ভাষান্তর: জনাথন স্টার। Jalaluddin Rumi: Gone to the unseen

কাঠামো পেরিয়ে

রাত্তিরে তোমার কাজের জায়গা কিংবা বাড়ি থেকে
যেই না রাস্তা পেরুতে পা বাড়াও— সামনে পড়ে কবরখানা।

তুমি শোনো— আমি তোমার অন্তরের অচিনপুর থেকে
তোমাকে ডাকি,
তোমার সামনের উন্মুখ কবরখানার দিকে চাইলেই
বুঝতে পারো—
আমাদের মধ্যে কোন ফাঁক নেই— আমরা একসঙ্গেই আছি!

তুমি যে মানবনিধি— আমি তার অন্তহীন সজ্ঞা
তোমার বিষাদের মর্মমূলে আমি আনন্দ উৎসার।

সে রাতের কথা ভেবে দেখো—
সাপে কাটার ভয়ে তুমি পালিয়ে গ্যাছো,
আর পিলপিলিয়ে শরীরে উঠে আসছে পিপড়া,
তারমাঝে মোম জ্বলে আছে, আমি ডাকছি তোমায়—
শুনতে পাও আমার চিরচেনা গলা,
ধুপবাতির ঘ্রাণ নীরবে মৌমৌ;
খাবারের আয়োজন দেখে তুমি রীতিমতো হতবাক!

একজনের ভালোবাসা কতো প্রাণের অন্তরালে
ফল্গুধারায় জাগে।

জানি আমার তারস্বরে তোমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে,
আমি এভাবেই চেঁচাই— তুমি যেন কবরে মাতমে জ্বলে ওঠো।

কাফনের কাপড় নিয়ে অনুযোগ করো না,
গোরস্তানের পথ থাক না ধুলামলিন, তাতে কী!

শবদেহে মোড়ানো কাপড় ছেঁড়া হয় গেরোদেয়া কোণায়।

আখেরাতে দীর্ণ মানুষের স্বনন ধুয়ে দেয়
মৃতদের শ্রান্তি ও ঘাম!

আমাকে খোঁজো না মানুষের দেহ-খাঁচায়
ভালোবাসার তীব্র ঝড় আমাকে ভেঙে একাকার করে দিয়েছে
সকল আকার, ক্ষেত্রফল ও মালিকানা।

বাজাও ডঙ্কা, কবিকে আমন্ত্রণ— বলুক তিনি পদাবলী কালাম।

এদিন এসেছে সেদিনের কাছে— যেদিন তুমি পরিশুদ্ধ
হতে পারো— যারা পেয়েছো বোধের মখমল,
যারা প্রেমের আঙিনায় আসবে বলে নিয়ত করেছো।

তুমি মৃত্যুর কিনারা অবধি অপেক্ষা করো না,
এখানে বহুকিছু চাওয়ার আছে যা টাকার চেয়ে দামী,
কেবল বিখ্যাত হয়ে ওঠার কী-বা মূল্য আছে বলো—
কাচ্চিবিরিয়ানি এমন কিছু নয় যার জন্য লালায়িত হও!

কী নামে ডাকি তারে—
এই নগরে গড়েওঠা নতুন এক নিরুদ্বেগের বাড়ি—

মানুষেরা বসে নিঃশব্দ, চোখ ডোবে সহজ দৃশ্য প্রভার কারণ

প্রশ্ন নেই, উত্তরে হাওয়ায় মেশে প্রাণের শনশন!

ইংরেজি ভাষান্তর: কোলম্যান বার্কস। Jalaluddin Rumi: No room for form.

নতশির চূড়া

আমি ছিলাম মৃত, সহসা আবার জীবন পাই;
কাঁদছিলাম, আবার হাসছি এখন।

আমার মধ্যে প্রেম জন্মায়,
আমি সিংহের প্রচণ্ডতায় মাতি,
তারপর সন্ধ্যাতারার স্নেহাশিসে আসমানে উদিত হই।

অধিকর্তা বলেন, তুমি এখনও যথেষ্ট উন্মাদ নও,
এই ঘরে তুমি থাকতে পারো না।

আমি বন্যতার চূড়ান্ত করি— তার বেশি কিছু করার ছিল না।

অধীশ্বর কহেন, এখনও সেরকম বন্য হয়ে উঠতে পারো নি
যাতে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারো।

আমি অতঃপর আনন্দের জোয়ারে উন্নীত স্তরে পৌঁছাই।

তিনি বলেন, না, না, এ যথেষ্ট নয়।

আমি মৃত্যুবরণ করি।

পরমেশ্বর বলেন, তুমি ভীষণ চতুর,
তুমি কানায় কানায় উচ্ছ্বাস আর দোটানার আধার!

আমি আমার শরীর থেকে সব পালক তুলে ফেলি
আর নিজেকে বানিয়ে ফেলি সম্পূর্ণ অবুঝ
তিনি ঘোষণা করেন, এই তো এতোক্ষণে তুমি হয়েছো
এই সমাবেশের মোমবাতি সম।

কিন্তু না, আমি মোমবাতি নই— ভালো করে দেখো
আমি ছড়িয়ে পড়ছি ধুঁয়ার টুকরো ও ছিন্নতায়।

তিনি বলেন, তুমিই এখন বুজুর্গ, তুমিই চলনদার।

কিন্তু না আমি শিক্ষক নই, আমার কোন ক্ষমতা নেই।

পরমনিধি কহেন, তুমি জানো না— তোমার পাখা আছে
আমি তোমাকে আর পাখা দিতে পারি না।

কিন্তু আমি যে পরমেশ্বরের ডানা চাই।
আমি যে এখনও পাখাহীন মোরগের ছানা হয়ে আছি!

আমি এবার এক গায়েবি আওয়াজ শুনি-
তুমি স্থিতধী হও, এক অলক্ষ্যের অনুকম্পা
তোমার মধ্যে প্রোথিত হোক— তুমি স্থির হয়ে থাকো!

আমি অতঃপর শ্রবণ করি আদিতম প্রেমের বাণী-
তুমি আমার নিবিড়ে রহো।

আমি কহি: আমি থাকিবো!

তুমি যে আলোকের এই ঝর্ণাধারা,
আমি গাছের কথায় লতায় পাতায় শ্যামলিমা ছায়া
আমার জীর্ণ বসনে তুমি মখমলের ছোপ।

প্রাণ বুঝি প্রভাতের কৃষ্ণ কালো জল
যে কানে কানে বলে, আলোকের এই ঝর্ণাধারায় বইয়ে দাও!

প্রভাকর মুখ লুকায় সন্ধ্যার আবীরের নিচে
আবার আলতো করে মুখ বাড়ায় চাঁদের কায়ায়
অসীম আকাশের নীল জ্যোৎস্না লহরায় সমস্ত ভাসায়!

তোমার হাসি ওই দূর হাসির গরিমায় মেশে।
এই সংসার দাবার ছকে খেলতে বসে না বড় খেলোয়াড়
নিঃসীমের আড়ালে থেকে চাল দেয় মৌল কারিগর।

আমি না-বোঝ, চালের গুটি
যেমনি বলো তেমনি খেলি— আমি আছি, আছি আমি
দাবার ছকে— তাইতো খুশি পরমপুরে নিত্য দিবস যামি!

ইংরেজি ভাষান্তর: কোলম্যান বার্কস। Jalaluddin Rumi: Sublime Generosity

মৃত্যুর গুমর

মৃত্যু এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গে বিবাহ।

এ কিসের গুমর? পরমেশ্বর তো অ খণ্ড।

সূর্যালোক জানালা গলিয়ে ঘরে ঢোকার বেলায়
ভেঙে চিলতা হয়।
আঙুর ফলের বাকল বহুবিধের যৌগ,
কিন্তু আঙুরের রসে কোন ভাগ নেই।

যে ঈশ্বরের আলোর নিরিখে বাঁচে
মৃত্যুর ফলে তার আত্মা আরেক বর্ধিত উদযাপনে
অধিষ্ঠিত হয়।

যে চলে গ্যাছে তাকে আর ভালো-মন্দের তকমায় বেঁধো না,
বরং তোমার চোখ একাগ্র করো ঈশ্বরে;
যে অদৃশ্য তাকে নিয়ে বেহুদা কথা বলো না—
সে হয়তো তোমার দৃষ্টির অতলে ভর করে আছে।

চর্মচক্ষুর দৃকপাত কেবলই এক জাগতিক আচার,
তারমধ্যে দেখাদেখির কোন অদেখা নেই,

কী নেই গোপনতার মর্ম!

অথচ এই চোখই যদি পরমার্থের বিভামণ্ডিত হয়
তাতে থাকতে পারে দেখার অন্তঃপুরে দেখার আড়াল।

সব আলোই পারমার্থিক উদ্ভাসের বিস্তার।

যে-কোন ঝলকানিকেই ঈশ্বরের নূর ভেবো না।
ক্ষণাচারী আলোর স্ফূর্তি হতে পারে শুধুই দুনিয়াদারির জরি।

ঈশ্বর, কেবল তুমিই জানো আলোর কী মাজেজা!

তোমার আলোয় মিলনের তীব্র বাসনা লইয়া পক্ষী
তোমা পানে ধায়!

Jalaluddin Rumi: Secret Of death

জালালউদ্দিন রুমি ১২০৭ সনের ৩০শে সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বালেখে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের প্রারম্ভিক বিলোড়ন থেকেই তিনি এক আধ্যাত্মিক উন্মত্ততার ভিতর বড় হয়ে উঠতে থাকেন: রুমির জনক বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ একইসঙ্গে তাঁর জন্মদাতা পিতা ও মুরশিদ। ক্রমান্বয়ে রুমি অতুল সিদ্ধপুরুষ ফরিদউদ্দীন আত্তার, এবং হাকিম আবদুল মাজিদ মাজদুদ ইবনে আদম সানাই গজনভির সংস্পর্শে আসেন, মাওলানা রুমি সঠিকভাবেই তৎকালে বুজুর্গ পণ্ডিত, ধর্মের ব্যাখ্যাকার, কাজি, মুরশিদ ও অনন্য এক ধর্মতত্ত¡ বিশারদে পরিণত হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই সামগ্রিক প্রস্তুতির পরও জালালউদ্দিন রুমির জীবন এক অন্য স্তরে সমাসীন হয় যেদিন তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে শামস তাব্রিজির সাথে। বলা হয়, তাব্রিজি এবং জালালউদ্দিন রুমির দেখা হলে একজন আরেকজনের পায়ের ধুলি নিতেন: এভাবেই দৃশ্যত আশেক-মাশেক, গুরু-শিষ্য, ছাত্র-শিক্ষক, পীর ও মুরীদানের মধ্যকার দূরত্ব ঘুছে এক নোতুন পরম্পরা তৈরি হয়: লাভার ও বিলাভেডকে আলাদা করার শরিয়া লুপ্ত হয়ে যায়— এ যেন থিসিস নয়, নয় এন্টিথিসিস— এ হলো সিনথেসিসের খেলা: যেভাবে স্রষ্টা মানুষের গোপন— মানুষ আব্রু।

দার্শনিক কবি জালালউদ্দিন রুমি ১৭ই ডিসেম্বর, ১২৭৩ সনে তুরস্কের কোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।

বদরুজ্জামান আলমগীর
বদরুজ্জামান আলমগীর
কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতরনদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলোদূরত্বের সুফিয়ানা। প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস। ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন। জালালউদ্দিন রুমির কবিতা, মসনবি : মোরাকাবা ও জলসংগ্রহ। ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা। নাটক : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসেপুণ্যাহ। আবের পাঙখা লৈয়া। জুজুবুড়ি। চন্দ্রপুরাণ। পানিবালা। বাঘ। পরীগাঁও। প্রত্ন প্রতিমা। ইলেকশন বাজারজাতকরণ কোম্পানি লিমিটেড। এক যে আছেন দুই হুজুর। পিঁয়াজ কাটার ইতিহাস। ডুফি কীর্তন। নুনমধু টিপসইপানিফল সংবেদ।।
এইরকম আরও পোস্ট
- Advertisment -
ad place