Monday, December 22, 2025
Homeসবিশেষঈদ সংখ্যা ২০১৮বিড়ালপাখি । আহমদ সায়েম

বিড়ালপাখি । আহমদ সায়েম

ভাঙা-ভাঙা শব্দে কথা বলে তনুশ্রী। বয়স আড়াই বা তিন হবে। তার পাকা পাকা কথায় মনে হবে বুড়ি একটা।

যত বায়না-আবদার বাবার সাথেই সব। মাকে ভয় পায় তেমন কিছু না, তবে বাবাকেই গুরুত্ব দেয় তনুশ্রী।

পিঠের ওপর ঘোড়া চড়া, ট্যাবে গেম খেলা, বিছানায় শুয়ে-শুয়ে রান্নাবাটি খেলা বা গল্প শোনা সবই বাবার সাথে। এমনই একদিন শুয়ে-শুয়ে বাবাকে প্রশ্ন :

তনুশ্রী — বাইরে জানালার দিকে তাকিয়ে – বাবা, বাতাস নড়তেছে কেন?
বাবা — গাছের পাতা মা!!
তনুশ্রী — গাছের পাতা নড়বে কেমন করে বাবা!? বাতাসের জন্য পাতা নড়তেছে।
বাবা — ও তাই তো, হ্যাঁ মা।
তনুশ্রী — তুমি কিচ্ছু বোঝ না, তুমি ‘টম’হয়ে যাচ্ছ বাবা।

বৃষ্টি হচ্ছে এমন সময় বাবার ঘরে ফেরা। তনুশ্রী — এদিকে আসো বাবা, এই দেখো – আমাকে তো খালি-খালি বকা দাও, আমি তোমার ঘরে, বারান্দায় সি (প্রস্রাব) করে দেই, এখন যে বৃষ্টি তোমার বারান্দায় সি করলো, তারে বকে দাও!!?

বাবা — মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বল্লেন বৃষ্টি তো বোকা মেয়ে-একটা, তুমি তার মতো না কী, বৃষ্টির বুদ্ধি নাই, তার তো বাথরুমও নাই, তাই আমাদের বারান্দায় সি করেছে …।
তনুশ্রী — তাই বলে সবখানে বাবা! তুমিও তো ভিজে গেছ?
বাবা — ঐ যে বল্লাম, তার তো বুদ্ধি নাই। আচ্ছা, আমি বকে দেবো।
তনুশ্রী — বকে দিও, তা না হলে আমিও বৃষ্টি হব।
বাবা — না না মা, বৃষ্টির মতো তোমাকেও সবাই বোকা বলবে, কেউ আদক করবে না তখন।

ছুটির দিনে বাবার সাথেই বেড়ানো, আর তনুশ্রীর বেড়ানোর জন্য প্রিয় স্থান নানুর বাসা, বাবার ফুফুর বাসা। নাইকল দাদুর বাসায় যাব বলে একবার কান্না শুরু করে দিলে অন্য কোথাও যাবার সুযোগ নেই, আর না যাওয়া পর্যন্ত কান্নাও চলতে থাকবে।

ঘরে ঢুকতেই তনুশ্রীর চিৎকার বাবাআআআ — আমার পাখিটাকে পেয়ে গেছি বাবা। পাখিটা একা একাই বাসায় ফিরে আসছে।

জায়গাটার নাম রায়নগর, কিন্তু সে তা শর্টকাটে ‘নাইকলদাদুর বাসা’বলে চালিয়ে দেয়। এই শর্টকাটের নামটা তার নানুরও খুব প্রিয়। নাইকলদাদু বলা মাত্র নানু তাকে বাড়তি কিছু আদর করে দেন।

কিন্তু তনুশ্রী দাদুর এই আদর খাবার জন্য উনার বাসায় যায় না। সে নানুর নানান রকমের পাখি মোরগ-হাঁস ও বিড়ালের সাথে খেলা ও আদর দেয়ার জন্য যায়।

অদ্য শাদা ও সোনালি কালারের দুইটা বাচ্চা হয়েছে বিড়ালের, যা দেখে তনুশ্রী এবার বায়না ধরেছে ছানা দুইটার একটাকে সে বাসায় নিয়ে যাবে। আর তার বায়না মানে — সফলতার জন্য সে অটল, ফেরানো যাবে না কোনোভাবেই।

কান্নাকাটি ও জেদের উচ্চতাকে ম্যানেজ করতে বিড়ালের একটা বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ফিরতে হলো বাসায়।

বিড়ালছানার নাম দিয়েছে ‘পাখি’। ঘরে তাকে যে নামে ডাকা হয়, তনুশ্রী সেই নামেই বিড়ালটাকে ডাকে।

— ‘আমার পাখিটা কই রে’ সারাদিন এই ডাকটা ঘরের দেয়ালে দেয়ালে উড়ে বেড়ায়, আগে ‘পাখি’ডাকটা শুধু তনুশ্রীর একার ছিল, এখন ডাকলে দুইজনই ছুটে আসে মায়ের কোলে, কখনো বাবার আদরের ছায়ায়।

নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে তনুশ্রী এখন তার পাখিটাকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত। কিন্তু বিড়ালটার ‘মন’ এখানে কোনোভাবেই টিকছে না। সারাদিন মেও-মেও শব্দে ঘর মাথায় তুলে রাখছে। কোনোভাবেই যেন তারে শান্ত করা যাচ্ছে না।

ছয়-সাত দিনের মাথায় ‘পাখি’টাকে ফেরত দেয়ার জন্য নাইকল দাদুর বাসায় যাওয়া হলো, বাচ্চাটা তার মা বিড়ালছানাটাকে পেয়ে নানান রকম খেলায় মেতে উঠল, এবং মায়ের আদরে আদরে অনেকটা সময় পার হয়। বিড়ালপাখি ও তনুশ্রীপাখি দুজনই এবার শান্ত।

তনুশ্রী নানুর সাথে নানান রকমের গল্প করছে : বোকা বৃষ্টিটা কীভাবে তাদের ঘরে আসলো, তাদের বারান্দায় সি দিলো আর বাবাকেরও ভিজিয়ে দিলো। বাবা শেষে বকে দিয়েছে। নানু তার সাথে বেশি কিছু বলার নেই, সায় দেয়া ছাড়া। নানু জানো — বৃষ্টির না কোনো বাথরুম নেই, বলে মুখ চেপে তনুশ্রীর হাসি।

— ঘণ্টা দুয়েক পরে বাসায় ফিরা হবে কিন্তু এখন আর বিড়ালপাখিটারে পাওয়া যাচ্ছে না। বিড়াল ও তার অন্য ছানাটা ঠিকই খেলতেছে বা এঘর ওঘর করতেছে কিন্তু তনুশ্রীর ‘পাখি’টাকে কোনোভাবেই পাওয়া যাচ্ছে না। নানান রকম চিন্তা সবার মাথায়, এভাবে হারিয়ে যাবার কোনো কারণ নেই, সবাই অবাক হচ্ছেন মা বিড়ালের চরিত্র দেখে, দুইটা বাচ্চার একটা মিসিং এই নিয়ে তার মধ্যে কোনো ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে না। দিব্যি আছে।

খোঁজাখুঁজিতে কোনো ভালো ফলাফল না থাকায়, তনুশ্রীর কান্নাকাটি ম্যানেজ করে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া হলো।

রাস্তায় তনুশ্রীর নানান ভাবনা ও বাবাকে নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় — পাখিটাকে কি কেউ কিডন্যাপ করল? না কি কেউ লুকিয়ে ফেলল বাবা?

বাবা — পাখিটা কি আসতে চাইল না! নিজে-নিজেই লুকিয়ে গেল? — ও বাবা পাখিটারে তো কেউ মারে নাই? তাই না বাবা?

তার বাবা এইসব আবেগ-ঘন প্রশ্নের বিশেষ কোনো উত্তর দিতে পারে না, বাসায় ফিরা হলো। তনুশ্রী তার ঘরে হেলেদুলে রওয়ানা হলো।

ঘরে ঢুকতেই তনুশ্রীর চিৎকার বাবাআআআ — আমার পাখিটাকে পেয়ে গেছি বাবা। পাখিটা একা একাই বাসায় ফিরে আসছে।

পাখিটাকে পাখির কোলে দেখে তার বাবার চোখও ছানাবড়া।

আহমদ সায়েম
আহমদ সায়েমhttp://raashprint.net
কবি, সম্পাদক, পুস্তকপ্রকাশক, স্থিরচিত্রগ্রাহক ও স্বতঃপ্রণোদিত তথ্যচিত্রনির্মাতা। আবির্ভাবকাল বিবেচনায় একবিংশ শতকের প্রথম দশকের লেখকদলের অন্তর্ভূত। পূর্বপ্রকাশিত কবিতাবই তিনটি : ‘অনক্ষর ইশারার ঘোর’ ২০১৫, ‘কয়েক পৃষ্ঠা ভোর’ ২০১৯, এবং ‘রুদ্ধজনের রাগ ও সম্বিৎ’ ২০২৫; অন্য বই ইংরেজিতে অনুদিত : ‘The layers of Dawn’ ২০১৮ সালে বের হয়েছে। সম্পাদনা করেন সাহিত্যপত্র ‘সূনৃত’ ও ওয়েবম্যাগ ‘রাশপ্রিন্ট’। ছোটকাগজ সম্পাদনায় পেয়েছেন ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস ২০১৩’ সম্মাননা। যুক্তরাষ্ট্রেরে প্রথম রাজধানী ফিলাডেলফিয়া, সেখানে প্রথম ‘বইমেলা ৩১ মে ২০২৫’ করতে সক্ষম হন। ফিলাডেলফিয়ায় প্রথম বাংলা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ এবং সম্পাদনা করেন ‘ফিলাডেলফিয়া, মে ২০২৫’ নামেই। নাট্যসংগঠনের সঙ্গে সংলিপ্ত। জন্ম ও বেড়ে-ওঠা বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী সিলেট শহরে ৫ জানুয়ারি ১৯৭৮ সালে। পেশাসূত্রে সপরিবার বসবাস যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। বিষাদমুক্ত, ভ্রমণপ্রিয়, বন্ধুবৎসল। ফোন : +1 (929) 732-5421 ইমেল: ahmedsayem@gmail.com
এইরকম আরও পোস্ট
- Advertisment -
ad place