১.
সকাল থেকেই আগুন! আগুন! রোদ ছিল। এখন কমলা রং বিকাল। পৃথিবীটা যেন সারাদিনের গরমে, ক্লান্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে! আর আরমান সাহেবের মাথার উপর ছড়িয়ে আছে বাঁশঝাড়, সরু পিচপথে ছায়া ছায়া বুনো শান্তি, ডান দিকে হঠাৎ হঠাৎ একতলা-দোতলা বাড়ির জানালার কাঁচে ম্লান-সূর্যের সাত রং চাগিয়ে উঠতে চায়!
নদীপারে সুপারি-নারিকেলের বাগান, মাঝেমধ্যে ঠাঁসা জঙ্গল। লতা-পাতার সতেজ গন্ধমাখা ফুরফুরে বাতাস ধন্য করেছে আরমান সাহেবকে। তিনি হাঁটছেন খুব আয়েশ করে। একটা সরকারী কলেজে ইতিহাস পড়ান। যদিও দেশ থেকে লেখাপড়া প্রায় উচ্ছেদ হয়ে গেছে তবু কিছু ছাত্রছাত্রী তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। পথে-ঘাটে দেখা হলে সালাম-কালাম বিনিময় করে।
আরমান সাহেব চারপাশটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন : রাস্তার বাঁ দিকে, হেলেপড়া বাঁশের কঞ্চিতে বসে আছে একটা মাছরাঙা। পাখিটার ধ্যান-মগ্ন চোখ নিচে, নদীর দিকে। ওপাশে, রাস্তার পরেই বর্ষার সুরমা তরতর করে ভাটির দিকে বইছে। তার বুকে জগতের সব জঞ্জালের সাথে ভেসে আসছে অসংখ্য জনপদের খবর, অজানা ইতিহাসের গোপন দীর্ঘশ্বাস। উচ্ছিষ্ট বস্তুগুলোর কোনোটা ডুবন্ত, কোনোটা ভাসা ভাসা!
নদীপারের প্রকৃতিকে মানুষ ইসরায়িলী দখলদারদের মতো নিষ্ঠুর ভাবে ধ্বংস করছে। তারপরও যে ছিঁটেফোঁটাটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকুতে মন চলে যায়। বিপন্ন প্রকৃতি লড়াই করছে নীরবে। কঠোর নিষ্ঠার সাথে। তাই পথের পাশে অচেনা ফুলের গন্ধে তার মন কান্দে। দুঃখ দুঃখ লাগে। নদী পেরিয়ে দৃষ্টি চলে যেতে চায় অনেক দূরে। কিন্তু ওপারে ঘরবাড়ি, স্কুল, সুউঁচ্চ মিনার বিশিষ্ট মসজিদের পাশে ছোট্ট একটি সবুজ টিলা। সে-ও বিপন্ন! হয়তো আসছে শীতের পর তাকেও দেখা যাবে না।
ফাঁকে ফাঁকে তরিতরকারির ক্ষেত, লাউ-শিমের মাচা। মাচার ছায়ায় বসে দুই কিশোর স্মার্ট ফোনে কীসব ঘাঁটছে। লেখাপড়া নাই, দায়দায়িত্ব নাই, বোধও নাই। এসব দেখবারও কেউ নাই! আছে শুধু প্রাণি-শাবকের মতো বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা!
একেবারে খামাখাই; আরমান সাহেব মন খারাপ করে ভূতের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখের সামনে থেকে ইজিবাইকটা সরে যেতেই বিষণ্নতা তাঁকে গ্রাস করে। অসহায়ের মতো একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হাতের দাগটা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। একটু কষ্ট হলেও মনে মনে ঠিক করে ফেলেন, আগামীকাল থেকে মুখ নিচু করে সিএনজি স্টপটা তাঁকে পেরুতে হবে। আর কিছুতেই তিনি মেয়েটির চোখে চোখ রাখবেন না।
২.
আসসালামু আলাইকুম।
হঠাৎ এক নারী-কণ্ঠ তাঁকে শুভ কামনা জানালে চিন্তামগ্ন আরমান সাহেব হকচকিয়ে উঠেন। চেয়ে দেখেন সেই মেয়েটি। যাঁর গম্বুজ গম্বুজ বুক তাঁকে লুব্ধ করেছে। অফিস-যাবার কালে যার সাথে তাঁর প্রায়ই সিএনজি স্টেশানে চোখাচোখি হয়; চোরা হাসি বিনিময়ের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পরের অন্ধকার আচ্ছন্ন মহাদেশে আলো ফেলছেন বেশ আগে থেকে। এই সুবাদে তারা একটু একটু পরিচিত। তাই মুখে মিটিমিটি হাসি ফুটিয়ে মেয়েটিই প্রথম কথা বলেন; আপনি এখানে?
আরমান সাহেবের দুই কান শরমে গরম হয়ে ওঠে! আত্মরক্ষার্থে তিনি মিথ্যা বলেন; সামনেই বন্ধুর বাড়ি।
ঘনিষ্টজনের মতো মেয়েটি এবার তাঁর দিকে পূর্ণ চোখে তাকান, দুই কদম এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ান। এই প্রথম তারা দু’জন পাশাপাশি। কথা বলতে গিয়ে তিনি অবাক! মেয়েটি তাঁর চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ ইঞ্চি বেশি লম্বা!
মুখমন্ডলের তুলনায় ছোট কিন্তু গভীর কালো চোখ দুটোতে মেয়েটির মুগদ্ধতা ঝলমল করছে। আরমান সাহেবের দেহ-মন চনমনা হয়ে উঠতে দেরি করে না। তিনি মেয়েটির লাল আর পুরুষ্ট ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এবার ওদুটো নড়ে ওঠে; বড় আপাকে দেখতে গেছিলাম। একটু পেছনেই তাঁদের বাড়ি।
আরমান সাহেব মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেলেন; আপনার সাহেব?
মেয়েটি মুখ নিচু করেন। লজ্জায় আরমান সাহেবের দুই কান আবার গরম হয়। তিনি আধাবোজা চোখে সব দেখেন : মেয়েটির দীর্ঘ আর মজবুত দেহ, কিশোরদের মতো ওপরের ঠোঁটে গোঁফের কালো রেখাটা খুব পস্ট! তাঁর সারাটা মুখ জোড়ে গোপন একটা ছায়া বেদনার মতো ছড়িয়ে আছে; যেটা তাঁকে করেছে সুন্দরী আর ব্যক্তিত্বময়ী। অন্তত আরমান সাহেবের চোখে। মনে মনে তিনি ঠিক করেন, যদি কখনো উপন্যাস লিখেন তবে প্রাধন চরিত্র হবে এই মেয়েটি : গা-গতর ধবধবে ফর্সা-হলুদ, গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা-চওড়া আর দেহের গড়নগাড়নও পুরুষের মতো শক্ত-পুক্ত। মাথার চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে, পর্বত পর্বত সামন দিক, ভারী নিতম্বের খাঁজ কোমর থেকে উঠে গেছে পিঠ পর্যন্ত। সরকারী প্রাথমিক স্কুলে পড়ান। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের যৌবন হলুদ চামড়া ফেটে পড়ে যেতে চায়। অথচ তার বিয়ে হচ্ছে না! তিনি বিশালদেহী এক নারী। ঠুঁটের ওপর গোঁফও আছে। তাঁকে নাড়াচাড়া করবার মতো ‘আগা আব্দুর রহমান’ বঙ্গদেশে কী বিরল?
মেয়েটি আড় চোখে আরমান সাহেবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত আরেকবার দেখে নেন : মোটা মোটা হাড়ের মেদহীন সবল আর দীর্ঘদেহী মানুষ। একটু লাজুক লাজুক গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, উজ্জ্বল ফর্সা রঙের সাথে চকচকে কালো দাড়ি-গোঁফ তাকে করেছে সুদর্শন। আর কড়া আতরের মতো পুরুষালি-ঘামের গন্ধ মেয়েটিকে আনমনা করে।
৩.
বুকে একটু চিনচিনে ব্যাথা নিয়ে আরমান সাহেব হাঁটতে শুরু করেন। পাশে পাশে মেয়েটি। তাঁর পায়ের গোড়ালিতে ময়লা! মনটা দমে যায়। তিনি ভাবেন মেয়েটি সুন্দরী, সমুদ্র সৈকতের মতো বিশাল ও লোভনীয় কিন্তু অলস-অপরিচ্ছন্ন। তাঁর ডান হাতের কব্জিতে একটা জন্মদাগ আছে। সাইজে পাঁচ টাকার কয়েনের মতো। কালচে আর স্যাঁতসেঁতে দাগটায় চোখ পড়তেই আরমান সাহেবের দেহমন ঘিনঘিন করে ওঠে।
পেছন দিক থেকে একটা ইজিবাইক আসছে। সরু রাস্তার এক পাশে তাঁরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষ করেন। তাঁদের পেছনে জঙ্গল, সামনে রাস্তা পেরিয়ে নদী। মেয়েটি নদী দেখতে দেখতে হঠাৎ আরমান সাহেবকে চোরা চোখে আরেকবার দেখেন : পুরুষ! তবু তাঁর নাকের ডান পাশে একটা তিল আছে! যা একটুও মানায়নি। কালো টি-শার্টের সাথে সে পড়েছে ছাইরঙ প্যান্ট! মেয়েটির সুন্দর নাকটা একটু কুঁচকে ওঠে।
যাত্রী শূন্য ইজিবাইকটা কাছাকাছি আসতেই তিনি বলেন; ভালোই হয়েছে।
মুখের তুলনায় ছোট চোখ দুটোতে ঝলক দিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করেন; আপনি যাবেন না?
বন্ধুর সাথে দেখা করাটা খুব জরুরী।
প্রথমে গুনগুন, তারপর শোঁ শোঁ শব্দ তুলে ইজিবাইকটা চলতে শুরু করে। নদী দিয়ে পাথর বোঝাই দুটো ইঞ্জিন বোট যাচ্ছে; শব্দে কানে তালা লাগে। মেয়েটি ইজিবাইকের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাঁর দিকে তাকান। আরমান সাহেবের চোখ দুটোতে বুঝি মেয়েটির করুণ! করুণ! দৃষ্টিটা গেঁথে গেল?
৪.
একেবারে খামাখাই; আরমান সাহেব মন খারাপ করে ভূতের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখের সামনে থেকে ইজিবাইকটা সরে যেতেই বিষণ্নতা তাঁকে গ্রাস করে। অসহায়ের মতো একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হাতের দাগটা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। একটু কষ্ট হলেও মনে মনে ঠিক করে ফেলেন, আগামীকাল থেকে মুখ নিচু করে সিএনজি স্টপটা তাঁকে পেরুতে হবে। আর কিছুতেই তিনি মেয়েটির চোখে চোখ রাখবেন না।
৫.
আরমান সাহেব একটা সিগারেট ধরান। কিছু ধূঁয়া তাঁর মাথার উপর দিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায়, কিছু আটকে থাকে মুখগহ্বরে-শ্বাসসনালীতে আর কালো নিকোটিন গোপনে মিশে রক্তে! কিছু মুহূর্ত কান্নার মতো রেশ তুলে শুধু শুধু অসীমে মিলায় তবু সব ফুরায় না। তাই বুনো প্রকৃতির মধ্যে জনমানব শূন্য রাস্তাটা বুঝি হাই তুলে। পাশের জঙ্গল থেকে এসে যোগ দেয় অচেনা ফুলের গন্ধ তবু তিনি আমোদ পান না। শুধু তাঁর চোখে আটকে থাকে মেয়েটির সুন্দর কিন্তু জন্মদুঃখীর মতো করুণ চোখমুখ।
…

জন্ম : জয়ধরখালী, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ।
গল্পের বই : উল্টারথে- ২০০৮, ভাতবউ- ২০১৩, অসুখ ও টিকনের ঘরগিরস্তি ২০১৭, ফলের নামটি ভুবননটী, ২০২৩।
উপন্যাস : আত্মজীবনের দিবারাত্রি- ২০১১, রাজকুমারী- ২০১৯, চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ- ২০২৪।
কিশোর উপন্যাস : সুতিয়া নদীর বাঁকে, ক্লাস অভ ভুত, সুমাভূতের কাণ্ড।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস: কালো মাটির নিঃশ্বাস।
