একটি ফরিয়াদের খসড়া
ঢাকা থেকে মিনারা তাবাসসুম আজ সকালে
জিজ্ঞেস করছেন— জারিফ ভাই, আপনাদের ওখানে
শীতের মেজাজ মর্জি কী?
আমি তো এখানে ঠাণ্ডায় পায়েশের চামচের মত
হয়ে গেলাম— সোজা, আবার সামনে একটু বাঁকা!
সত্যিই বিরল শীত পড়েছে এবার।
আমি গত পরশু এসেছি পিটসবার্গে— টেম্পারেচার
দুই ডিগ্রি ফারেনহাইট, নেগেটিভের অনেক নিচে।
আমি বললাম— তাবাসসুম, আপনি ঠাণ্ডায়
পায়েশের চামচ হয়েছেন, আর এখানে দেখছি
এক হোমলেস ম্যাপল গাছের খানিক আড়ালে
দাঁড়ায়ে হিসু করছে— বেচারির মাননীয় হিসু
বরফ হয়ে টপাটপ মাটিতে পড়ছে!
আমার অবশ্য একশিসে অনেকদিন পর
শাহবাগে পিজি হাসপাতালের পিছনে দাঁড়িয়ে যাবার
এমন নজরকাড়া স্মৃতিটুকু মনে পড়ে গেল।
ঠাণ্ডার এই দশার কথা শুনে মিনারা বলে,
ভাবছি— দেশ ছেড়ে যাবার জায়গা আমার একটাই—
সৌদি আরব, বলেই বেপরোয়া হাসি ওর।
আমি বলি, রাব্বুল আলামিন আপনার দিলের বাস্নাই
পূরণ করবেন ইনশাআল্লাহ।
আমার এক কবি বন্ধু বলতো— আমি কোনদিন
ইশকুলে যাই নাই, ইশকুলই আমার কাছে আসতো!
মাশাল্লাহ আপনারও সৌদি আরব যেতে হবে না
বাংলাদেশই সৌদি আরব হয়ে যাবে,
এই তো দুইটা দিন সময় দেন জাযাকাল্লাহ খাইরান।
মহান আল্লাহ পাকের কাছে আমার একটাই ফরিয়াদ—
হে পরোয়ারদেগার, আমার দুইটা হাত তুমি
তামাম দুনিয়ার সমান বড় করে দাও—
আমি যেন দুইহাত পেতে তোমার ভিক্ষা নিতে পারি—
এই আমার দেশ, লক্ষ লক্ষ নারীপুরুষ দেশের লাগি
তাদের জীবন দিচে, নারী তার সম্ভ্রম দিচে।
আসমান থেকে তুমি তাদের রিয়ালে, দিরহামে
শিলাবৃষ্টির মতন ছুঁইড়া মারো— আমি দুইহাতে ভিক্ষা লই।
আমাদেরে তুমি বারবার মিসকিন কেন বানাও
পাঠাও খালি বদ রাজাদেশে রিয়ালের গোলামির কাছে?
ভিক্ষুক
একটি অন্ধ পরিবার গান গায়, ভিক্ষা করে।
কাল হঠাৎ কিছু নেকদার মানুষ তাদের
গান গাইতে বারণ করে,
বলে, নবীর নামে কদমসে হাঁক দে
থালা বাড়ায়ে ভিক্ষা চা, একদম গান গাবি না!
তারা দুয়ারে ভিক্ষা চাইতে যায়, কিন্তু কেঁদে ফেলে—
ভিক্ষা চাইতে পারে না।
তাদের আত্মসম্মানে লাগে,
মনে হয়, ওদের পূর্বপুরুষ তাদের সামনে খাড়া।
এই প্রথম তাদের নিজেদের ভিক্ষুক মনে হয়,
আগে মনে হতো ওরা একটি শিল্পী পরিবার
পথে পথে গান করে,
ওরা দোতারার ছেঁড়া তার, ময়নাপাখির ভাই।
এখন কেবলই ভিক্ষুক—
দুনিয়ার একমাথা থেকে আরেক মাথা ক্ষুধা
কিন্তু ভিক্ষা চাইতে পারে না, কাঁদে— একলা!
হরিণচরিত মানস
নবীজির আমলে মক্কা ও মদিনায় সবুজ ছিল না
ছিল এরা সত্যিকার পাথর কাঙ্কর বিছানো খাখা
কিন্তু তখনও এই অফুরান অগুনতি নদীর আবেশে
সজনে ডাঁটা মানুষের বুকের চৌহদ্দিতে একেকটা
সবুজ গম্বুজ ছিল, ছিল সবুজ পিপাসার সুন্দরবন।
নূরের নবী মোস্তফায় সবুজ আঞ্জাআঞ্জি গোপাট ধরে
হেঁটে যায়, রসুল দেখেন এক মা হরিণ যে বান্ধা আছে
গাছের গোড়ায়, হরিনী ভাঙা মনে পয়গম্বর পানে চায়,
নূরের দূত বোঝেন— মা হরিণ কাঁদে তার শাবকের তরে
শিকারীকে তাই নবী আতুফ বলেন, ছাড়ো হরিণ ছাড়ো
বাচ্চার মুখে স্তন্য দিয়ে হরিণা ফিরবে দেখো আবারো।
শিকারী কহে, কী প্রমাণ— বন ঘুরে হরিণী ফিরবে ফের?
তোমার সন্দেহে আমাকে বাঁধো গাছে, বদলা হরিণের।
হরিণী আসে ফের শিকারীর কাছে বনে স্তন্যদান শেষে
দেখো, জল আর আতরের উতল তিয়াসে নবীজি হাসে।
মক্কা ও মদিনা মরুভূমির ত্রাস ধুলি আর হাওয়ার চাবুক
এই বাংলা বানায় সবুজের নবী— বলো তারে সত্য ভাবুক।
আচানক মোস্তাহাবের দেশ
আগে ভাবতাম— এই যে সারা দুনিয়ার মানুষ দেখতে পাই—
সব দেশের সকল জাতিধর্মের, গোত্রের, বর্ণের, কায়দাকানুনের মানুষ দেখি— এ তো আল্লাহর উপঢৌকন,
তারই ধারাবাহিক রহমত।
আজকাল অবশ্য কিছুটা ধন্দে পড়ি— দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না সবসময়, যাদবের পাটিগণিত প্রায়শই অঙ্কে মেলে না।
আজকাল তো ধর্ম সম্প্রদায় গোষ্ঠীগুলো ভীষণ মুখোমুখি, হাজাহাজি, মারণোন্মুখ, ছোরা বনাম কিরীচ,
একে-১২ বনাম এলজিএম ৩০ মিনিটম্যান কী অগ্নি-ভি।
আগে ওয়াট’স ইউর রিলেজিয়াস বিলিফ— জিজ্ঞেস করলে বলতাম- আই ডোন্ট ডু অরগাইজড রিলেজিয়ন,
আই এম এগনোস্টিক। কিন্তু এখন বলি— আই এম এ মুজলিম, বাট আই ডোন্ট নো ওয়াট কাইন্ড! মে বি প্রেয়ার কাইন্ড।
ওয়াট ডু ইউ মিন- প্রেয়ার কাইন্ড?
তখন আমি একটু ভেঙে ভেঙে বলি— দেখো, আমি ওই রকম একটা দেশের মুসলিম— যাদের কাছে ফরজের চেয়ে ওয়াজিব, বা মোস্তাহাবের দাম অনেক বেশি।
বাডি, গিভ মি এ ব্রেক ডাউন।
শিওর, শোন। যে— কোন দেশের, বিশেষকরে ইসলামের কেন্দ্রীয় তীর্থভূমি সৌদি আরবের মুসলমানদের দেখো— তারা নামাজ পড়ে যেন নামাজ ঠিক ইবাদত নয়— বুঝি এটা নিজের জন্য একটা করপোরেট নেটওয়ার্কের স্থিরিকৃত চাকরির হাজিরা দেওয়া।
আর আমাদের দেখো, আমরা ফরজ নামাজ পড়ি নিজের সালাতের জন্য নয়— আমরা নামাজ পড়ি মোনাজাতের জন্য— আমরা মোনাজাতে ফানা চাই যতো না নিজের জন্য— তার থেকে অনেক বেশি সন্তানের, বাবা-মায়ের, ভাইবোনের, আত্মীয় স্বজনের, সবশেষে গোটা দেশের কল্যাণের লাগি বুকভাঙা কাতরতায়।
মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ ভূমি— যেখান থেকে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে— ওরা মোনাজাত করে না বললেই চলে, কেননা মোনাজাত ফরজ নয়, মোস্তাহাব। কিন্তু আমরা নামাজ যেমন তেমন— মোনাজাতের জন্য এক কেন্দ্রীয় সমর্পণের ঘন মজমায় লুটিয়ে পড়ি— যারে বলি আখেরি মোনাজাত!
…

কবি, নাট্যকার, অনুবাদক।
কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর।
নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।
প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।
ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।
জালালউদ্দিন রুমির কবিতা, মসনবি : মোরাকাবা ও জলসংগ্রহ।
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।
নাটক : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। পুণ্যাহ। আবের পাঙখা লৈয়া। জুজুবুড়ি। চন্দ্রপুরাণ। পানিবালা। বাঘ। পরীগাঁও। প্রত্ন প্রতিমা। ইলেকশন বাজারজাতকরণ কোম্পানি লিমিটেড। এক যে আছেন দুই হুজুর। পিঁয়াজ কাটার ইতিহাস। ডুফি কীর্তন। নুনমধু টিপসই। পানিফল সংবেদ।।

কবিতা গুলো অন্যরকম। খুব ভালো লাগলো।