Tuesday, December 23, 2025
Homeপ্রবন্ধচত্বরঐতিহ্যের বিস্তার ও একটি রিসোর্ট । আহমদ সায়েম

ঐতিহ্যের বিস্তার ও একটি রিসোর্ট । আহমদ সায়েম

মোঘল আমলের স্থাপত্যকলার আদলে গড়ে তোলা ইমারত বাংলাদেশে অবিরল নয়, আবার একেবারেই বিরল তা-ও বলা যাবে না। আছে। যেগুলো আছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যায় গাফিলতি দৃষ্ট সর্বত্র। তদুপরি নিত্যকার মূল্যবোধ ও জনরুচির রূপান্তর, জীবনযাত্রাগত পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে এদেশের স্থাপত্যশিল্পের কালানুক্রমিক শোভা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ কোথাও নেই। চিত্র সর্বত্র সমান। চৌষট্টি জেলার মধ্যে কেবল সিলেটের ছবিই যদি ফিরে দেখা হয়, দেখা যাবে এক-দেড়দশক আগেও নয়নাভিরাম যে-ভিটেবাড়িগুলো পুরনো সেই দিনের কথা আর আঘ্রাণ নিয়া হাজির ছিল নগরীর আনাচেকানাচে, সেখানে এখন বহুতল অট্টালিকা। প্রায় ছিরিছাঁদহীন হয়ে যাচ্ছে এইভাবে বাংলাদেশের নগরগুলোর নিসর্গ ও নন্দন। শিল্পবোধহীন ভবনের অপরিকল্পিত সারি দিয়ে সয়লাব হয়ে গিয়েছে দেশ ও চারিপাশ।

তবু এর মধ্যেও নতুন কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ে মাঝেমধ্যে। এবং আশার সঞ্চার হয় যে ফেরানো কঠিন হলেও অসম্ভব নয় আমাদের নিবাসবাড়ির ছিরিছাঁদগত ঐতিহ্য। সম্প্রতি সিলেটে বেশকিছু মনোরম রিসোর্ট হয়েছে যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধ লক্ষ করা যাচ্ছে। কেবল অর্থলগ্নি এবং মুনাফাই লক্ষ্য নয় রিসোর্ট-উদ্যোক্তাদের, তারিফযোগ্য নন্দনের নিদর্শন রেখে যাবার চেষ্টাও লক্ষণীয় লগ্নিকারীদের মধ্যে। এমনই একটি রিসোর্টের পরিচিতিমূলক সংক্ষেপ নিয়ে এই প্রতিবেদন। রিসোর্টের নাম রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট। সুরমা নদীর দক্ষিণ দিগন্তের গাছপালা আর টিলাবেষ্টিত এলাকায়, মানে দক্ষিণ সুরমায়, রিসোর্টটির অবস্থিতি।

বিস্তর ইতিহাসখনক না-হলেও সর্বসাধারণ বাঙালির কাছে মোঘল রাজাবাদশাহির বহুকিছুই চিরপরিচিতের মতো। বাঙালি নিয়েছেও অনেক এই আমলের রেকাবি থেকে, যেমন রান্না আর স্থাপত্যশৈলীর উল্লেখ করা যায় এর শীর্ষে। এটা প্রায় সবাই জানে যে মোঘল সাম্রাজ্যটি ছিল ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল নিয়েই বিস্তৃত। অঞ্চলটি সেসময় হিন্দুস্তান বা হিন্দ্ নামে পরিচিত ছিল। মোঘল সাম্রাজ্য ১৫২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৭০৭ সাল পর্যন্ত এর ডানা বিস্তার করে রেখেছিল। ১৮৫৭ সালের দিকে এর পতন ঘটে। ব্যাস্, এই পর্যন্তই থাক, মানে মোঘল ইতিহাস রচনার কোনো ইচ্ছে নেই এই লেখায়। তবে আমার মতো অনেকেরই মোঘলিয়ানা মনে পড়ে যেতে পারে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত রিজেন্ট পার্ক রিসোর্টের সদর-ফটক পেরিয়ে ঘাস আর জঙ্গলের আরণ্যক প্রতিবেশে হাঁটতে গেলে।

রিসোর্ট 4 রিসোর্ট 11এই রিসোর্টের পুরাতন দেয়াল আর ইমারতের ঘুলঘুলি দেখলে সেই সময়ের চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, সম্রাট আওরঙ্গজেব, শেখ মির্জার ছেলে বাবর, বাহাদুর শাহ, শায়েস্তা খাঁ, নূরউল্ল্যাহ খাঁ থেকে দিল্লীর লোদী বংশীয় সর্বশেষ সুলতান পর্যন্ত মনে পড়ে যেতে পারে দর্শনার্থীর। সমস্ত রিসোর্ট হেঁটে এসে সানদানী পুকুরঘাটে বসলে মনে হবে ইতিহাসপাতা উল্টানো শেষ হলো। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার সময় কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য অবগত হওয়া গেল। শোনা গেল, এই রিসোর্টের সবগুলো স্থাপনাই শত-শত বছরের পুরানো। পঁচিশ বিঘা জমির উপর করা এই রিসোর্টটি একসময় একজন জমিদারের বাড়ি ছিল। জমিদারের নাম ছিল প্রসন্ন কুমার চত্রুবর্তী, উনার পিতা শ্রী পদ্মলোচন চত্রুবর্তী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছরে, ১৯৭১ সালে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে-আগে পারিবারিক সুবিধার জন্যেই ওপার-বাংলার মুসলিম জমিদার করিমগঞ্জের আব্দুল আজিজ চৌধুরীর    সঙ্গে তাদের জমিদারিত্ব এবং তৎসংক্রান্ত সমস্ত সম্পত্তির বিনিময় হয়। এরপরের ইতিহাস তো বহু চড়াই-উৎরাই পেরোনো।

সময়ের সেতু পার হতে-হতে বাড়িটি মানুষশূন্য হয়ে পড়ে। শূন্য বাড়িতে মাকড়সার জাল ঝুলে রয় বটের ঝুরির মতো, বয়স বাড়ে কেন্নোকীটপতঙ্গের, বানর বাদুর সহ আরো নানান পশুপাখি ঠিকানা করে নেয় ঘরের কোণে, কেউ ঘরের ছাদে, কেউবা গাছের ডালে। এমন নিঃসঙ্গ আর শূন্য ঘরবাড়ি একনজর দেখতে একদিন দেশে ফেরেন জমিদার আব্দুল আজিজ চৌধুরীর চার ছেলের একজন মনজু চৌধুরী। দেশে ফিরলেও বাড়িতে তাদের আর থাকা হয় না, তারা শহরের কুমারপাড়ায় বাসা করে নিয়েছেন, বাসার নাম দিয়েছেন করিমগঞ্জ হাউজ। একদিন পুরাতন দুই বন্ধুকে নিয়ে আসেন বাপদাদার আমলের পুরানা বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। আর এই দেখে যাওয়াটাই ছিল স্বপ্ন বুননের রাস্তা। মনজু চৌধুরী অচিরে তার দুই বন্ধুর হাতে তুলে দেন পাখির নিশ্চিন্ত নীড় আর উইপোকার ঢিবিগুলো। চৌধুরী সাহেবের দুইবন্ধু মো. ফখরুজ্জামান ও হেলাল উদ্দিন তাদের সশ্রম মেধা ও সৃজনকুশলতা খাটিয়ে উইপোকার ঢিবিগুলোকে রূপান্তরিত করেন মোঘল সাম্রাজ্যের মিনিয়েচার ভার্শন হিশেবে। নাম রাখেন ‘রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট’।রিসোর্ট 5 রিসোর্ট 7রিসোর্ট 10

যেভাবে যাবেন : সিলেটের বাইরে থেকে যারা আসবেন তারা শহর সন্নিকট হবার বেশ আগে, সুরমা নদী পেরোনোর আগে অর্থাৎ দক্ষিণ সুরমায়, আব্দুস সামাদ ই-স্কয়ারে নেমে যাবেন। নেমেই দেখবেন সুবিশাল নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজের কম্পাউন্ড চোখে পড়বে। এখান থেকে আপনাকে নর্থ-ইস্ট মেডিকেলের সামনের দিক দিয়ে জলালপুর রোডের গাড়ি ধরতে হবে। শেয়ারের সিএনজিচালিত ট্যাক্সি করে গেলে জনপ্রতি লাগবে ১০ টাকা, টাউনবাসে করে গেলে ৫ টাকা। ট্যাক্সি কিংবা বাস্ বা রিকশা সবই পাওয়া যায়। ট্যাক্সি রিজার্ভ চুক্তিতে গেলেও স্কয়ার থেকে ৫০/৬০ টাকার বেশি ভাড়া লাগবার কথা নয়। সিলাম রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট বললে যে-কোনো চালকই ঠিকঠাক রিসোর্টতোরণে নামিয়ে দেবেন আপনাকে। এই রিসোর্ট থেকে সিলেটের যেখানেই যেতে চাইবেন সহজে এবং অনায়াসেই পারবেন। শহরদর্শন এবং শহরের বাইরে যে-কোনো নয়নাভিরাম জায়গায় যেতে চাইলে রিসোর্ট থেকে আপনি নিজেই যানবাহন ও অন্যান্য ব্যবস্থাদি করে নিতে পারবেন। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিয়েও আপনি আপনার ট্যুরপ্ল্যান করে নিতে পারেন। আপনার চাহিদামাফিক লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের পৃথক বিভাগ রয়েছে।

আহমদ সায়েম
আহমদ সায়েমhttp://raashprint.net
কবি, সম্পাদক, পুস্তকপ্রকাশক, স্থিরচিত্রগ্রাহক ও স্বতঃপ্রণোদিত তথ্যচিত্রনির্মাতা। আবির্ভাবকাল বিবেচনায় একবিংশ শতকের প্রথম দশকের লেখকদলের অন্তর্ভূত। পূর্বপ্রকাশিত কবিতাবই তিনটি : ‘অনক্ষর ইশারার ঘোর’ ২০১৫, ‘কয়েক পৃষ্ঠা ভোর’ ২০১৯, এবং ‘রুদ্ধজনের রাগ ও সম্বিৎ’ ২০২৫; অন্য বই ইংরেজিতে অনুদিত : ‘The layers of Dawn’ ২০১৮ সালে বের হয়েছে। সম্পাদনা করেন সাহিত্যপত্র ‘সূনৃত’ ও ওয়েবম্যাগ ‘রাশপ্রিন্ট’। ছোটকাগজ সম্পাদনায় পেয়েছেন ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস ২০১৩’ সম্মাননা। যুক্তরাষ্ট্রেরে প্রথম রাজধানী ফিলাডেলফিয়া, সেখানে প্রথম ‘বইমেলা ৩১ মে ২০২৫’ করতে সক্ষম হন। ফিলাডেলফিয়ায় প্রথম বাংলা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ এবং সম্পাদনা করেন ‘ফিলাডেলফিয়া, মে ২০২৫’ নামেই। নাট্যসংগঠনের সঙ্গে সংলিপ্ত। জন্ম ও বেড়ে-ওঠা বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী সিলেট শহরে ৫ জানুয়ারি ১৯৭৮ সালে। পেশাসূত্রে সপরিবার বসবাস যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। বিষাদমুক্ত, ভ্রমণপ্রিয়, বন্ধুবৎসল। ফোন : +1 (929) 732-5421 ইমেল: ahmedsayem@gmail.com
এইরকম আরও পোস্ট
- Advertisment -
ad place