Monday, December 22, 2025
Homeপ্রবন্ধচত্বরপাওলো কোয়েলহো প্রণীত ‘আক্রায় পাওয়া পাণ্ডুলিপি’ (অংশবিশেষ) । বাংলা...

পাওলো কোয়েলহো প্রণীত ‘আক্রায় পাওয়া পাণ্ডুলিপি’ (অংশবিশেষ) । বাংলা : জাকির জাফরান

ZakirZafran 1মুখবন্ধ ও সম্ভাষণ

১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাস। প্রধান মিশরের হামরা-ডম এলাকা। দুই ভাই বিশ্রামের জায়গা খুঁজতে খুঁজতে এক গুহার মধ্যে পেয়ে গেল প্যাপিরাসভর্তি একটি ভস্মাধার। স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বলার পরিবর্তে  — আইন অনুযায়ী তা-ই হওয়া উচিত — তারা সরকারের দৃষ্টি এড়াতে সেগুলো প্রাচীন জিনিসপত্রের বাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলো। বালক দুটির মা এগুলোকে অশুভ শক্তি ভেবে কয়েকটি প্যাপিরাস পুড়িয়ে দিলো।

পরের বছর, কোনও কারণে যা ইতিহাসে উল্লেখ নেই, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হলো। এই ঝগড়াকে অশুভ শক্তির প্রভাব ভেবে মা প্যাপিরাস-পাণ্ডুলিপিগুলোকে একজন ধর্মযাজকের কাছে হস্তান্তর করল, যে-যাজক আবার সেগুলোকে কায়রোর কপ্টিক মিউজিয়ামের কাছে বিক্রি করে দিলো। সেখানে প্যাপিরাসগুলোকে নাম দেয়া হয়, যা আজ পর্যন্ত তা ই আছে : নাগ হামাদির পাণ্ডুলিপি (যে-গুহায় এগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার পার্শ্ববর্তী শহরের নামানুসারে)। মিউজিয়ামের একজন বিশেষজ্ঞ, ধর্মীয় ইতিহাসবিদ জ্যা ডরেসি এই আবিষ্কারের গুরুত্ব আনুধাবন করতে পারলেন এবং প্রথমবারের মতো ১৯৪৮ সালের একটি প্রকাশনায় এটার উল্লেখ করলেন।

অন্য প্যাপিরাসগুলো কালোবাজারে পাওয়া যেতে লাগল। মিশরীয় সরকার পাণ্ডুলিপিগুলোর দেশের বাইরে পাচার ঠেকাতে চেষ্টা করল। ১৯৫২-এর বিপ্লবের পর, অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি কায়রোর কপ্টিক মিউজিয়ামে হস্তান্তর করা হলো এবং জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হিশেবে ঘোষণা করা হলো। একটিমাত্র লেখা কোনও প্রকারে বাদ পড়ে যায়, এবং এটা বেলজিয়ামের একটি প্রাচীন সংগ্রহ বিক্রির দোকানে চলে আসে। নিউ ইয়র্ক ও প্যারিসে বিক্রির নিস্ফল প্রচেষ্টার পর, অবশেষে ১৯৫১ সালে কার্ল জাং ইন্সটিটিউট তা কিনে নেয়। বিখ্যাত মনোবিশ্লেষকের মৃত্যুর পর, প্যাপিরাসটি, এখন যা জাং কডেক্স নামে পরিচিত, কায়রোতে ফেরত আসে, যেখানে প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠা এবং নাগ হামাদি পাণ্ডুলিপির খণ্ডিত অংশ এখন পাওয়া যায়।

***

প্যাপিরাসগুলো কিছু আদি পাঠের গ্রীক অনুবাদ যা লেখা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষ ও ১৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে । আর এগুলো একটি কাজের অবয়ব গড়ে তোলে যা ‘অ্যাপোক্রিফাল গসপেল’ নামে পরিচিত, কারণ আমরা আজ যা জানি তা হলো এ-পাঠগুলো বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত হয় নি। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমন হলো?

১৭০ খ্রিস্টাব্দে একদল যাজক একত্রিত হন কোন পাঠগুলো নিয়ে নিউ টেস্টামেন্ট গঠিত হবে এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। মাপকাঠিটি ছিল খুব সহজ : যা-কিছুই জনশ্রুতি ও সময়ের মতবাদগত বিভাজনের সঙ্গে লড়াই করতে ব্যবহৃত হতে পারবে, তার সবই অন্তর্ভুক্ত হবে। চারটি গ্রন্থ বাছাই করা হলো। যাজকদের এই সভার উল্লেখ এবং তাদের গ্রন্থতালিকা মিউরেটরিয়ান প্রামাণিক রচনাবলিতেও পাওয়া যায়। অন্যান্য গ্রন্থ যেমন নাগ হামাদিতে পাওয়া গ্রন্থ বাদ দেয়া হয়, কারণ হয় সেগুলো নারীদের দ্ধারা লিখিত হয়েছিল (উদাহরণস্বরূপ, মেরী মেগদালিন-এর বয়ান মতে বাইবেলের পাঠ) কিংবা তারা এমন এক যিশুকে চিত্রিত করেছিল যিনি তার স্বর্গীয় মিশন সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং যার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তর্ধান সে-কারণে কম গুরুত্বপূর্ণ ও কষ্টকর হতো।

***
১৯৪৭ সনে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার ওয়াল্টার উইলকিনসন আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন, এবার তা তিনটি ভাষায় লিখিত : আরবি, হিব্রু ও ল্যাটিন। এ-ধরনের আবিষ্কারকে কোথায় আইনি সুরক্ষা দেয়া হয় এ-খবর নিয়ে তিনি গ্রন্থটিকে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীনতত্ত্ব বিভাগে পাঠিয়ে দেন। এর অব্যবহিত পরই জবাব আসে : এই দলিলটির কমপক্ষে ১৫৫টি কপি বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়েছে (এর তিনটি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে) এবং এর সবগুলোই একই রকমের ছিল। কার্বন-১৪ পরীক্ষা (জৈব পদার্থের বয়স নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়) এটা প্রকাশ করল যে দলিলটি ছিল তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালের, সম্ভবত ১৩০৭ এর দিকের। এটা বের করা খুব সহজ ছিল যে এর উৎপত্তি ছিল আক্রায়, মিশরের সীমানার বাইরে। সুতরাং দেশটি থেকে পাণ্ডুলিপিটি বের করে নিয়ে যেতে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না, আর স্যার ওয়াল্টার মিশরীয় সরকার থেকে (রেফা. ১৯০১/৩১৭/আই এফ পি-৭৫, তারিখ ২৩ নভেম্বর ১৯৭৪) এটি তার সঙ্গে ইংল্যান্ড নিয়ে যেতে লিখিত অনুমতি পান।

***
আমি স্যার ওয়াল্টারের পুত্রের সঙ্গে ১৯৮২ সালের ক্রিসমাসে ওয়েলস-এর পর্থমাডগ-এ সাক্ষাৎ করলাম। আমার মনে আছে সে বলছিল পাণ্ডুলিপিটি তার পিতা কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিল, কিন্তু আমাদের কেউই এ-বিষয়টিকে পাত্তা দিলাম না। আমরা একটি হৃদয়িক সম্পর্ক বজায় রাখলাম এবং কমপক্ষে আরো দুটি অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা হলো যেখানে আমি আমার বইয়ের প্রচারের জন্য ওয়েলস ভ্রমণ করেছিলাম।

২০১১-এর নভেম্বর মাসে পাণ্ডুলিপিটির একটি কপি আমি পাই যা সে প্রথম সাক্ষাতে উল্লেখ করেছিল। আমি এটি এখানে ভাষান্তরিত করলাম।

একটি পাতা, যখন সে শীতে গাছ থেকে ঝরে পড়ে, তখন কি ঠাণ্ডার দ্ধারা নিজেকে পরাজিত ভাবে?

গাছ তখন পাতাকে বলে : ‘এটাই জীবনের চক্র। তুমি ভাবতে পারো তুমি মরে যাচ্ছ, কিন্তু তুমি বেঁচে থাকো আমার ভেতরে। তোমাকে ধন্যবাদ যে আমি বেঁচে আছি, কারণ তোমার কারণেই আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি। তোমাকে আরও ধন্যবাদ যে আমি প্রেম অনুভব করতে পেরেছি, কারণ ক্লান্ত পথিকদের ছায়া দিতে পেরেছিলাম আমি। তোমার প্রাণ আমার প্রাণে; আমরা দুজনে মিলে একজন।’

একটি মানুষ, যে সর্বোচ্চ পর্বত আরোহনের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছে, কখনও কি নিজেকে পরাজিত ভাবে, যখন পর্বতে পৌঁছে সে দেখে যে প্রকৃতি ঝড়ো মেঘ দিয়ে পর্বতচূড়াকে ঢেকে রেখেছে? ঐ মানুষটি তখন পর্বতকে বলে : ‘এবার তুমি আমাকে চাওনি, কিন্তু আবহাওয়াও পরিবর্তিত হবে, এবং একদিন আমি তোমার চূড়ায় উঠবই। ততদিন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকো।’

জীবনের প্রথম প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একজন তরুণ কি এটা ঘোষণা দিয়ে বসে যে প্রেমের কোনও অস্তিত্ব নেই? যুবাটি তখন নিজেকে নিজে বলে : ‘আমি আরও ভালো কাউকে খুঁজে পাব যে আমার অনুভূতিকে বুঝতে পারবে। আর তখনই আমি আমার বাকি দিনগুলোতে সুখী হব।’

প্রকৃতিচক্রে জয়-পরাজয় বলে কোনও জিনিশ নেই : আছে শুধু গতিচাঞ্চল্য।

শীতকাল সবার ওপর রাজত্ব করতে চায়, কিন্তু অবশেষে, বসন্তের বিজয়কে মেনে নিতে বাধ্য হয়, যা সঙ্গে করে নিয়ে আসে সুখ আর পুষ্পপল্লব।

গ্রীস্মকাল চায় তার উষ্ণ দিনগুলি চিরদিন বেঁচে থাকুক, কারণ সে বিশ্বাস করে যে উষ্ণতা পৃথিবীর জন্য ভালো। কিন্তু অবশেষে, তাকে হেমন্তের আগমনকে স্বাগত জানাতে হয়, যা পৃথিবীকে বিশ্রামের সুযোগ করে দেবে।

হরিণ ঘাস খায়। আর সিংহ গিলে খায় হরিণকে। এখানে কে শক্তিশালী সেটা বিষয় নয়। এটা ঈশ্বরের আমাদেরকে মৃত্যু ও পুনরুত্থানচক্র দেখানোর পদ্ধতি বিশেষ।

এই চক্রের মধ্যে না আছে বিজয়ী না আছে পরাজিত, আছে শুধু বিভিন্ন পর্যায় যার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে অবশ্যই যেতে হয়। মানবহৃদয় যখন এ-বিষয়টি বুঝতে পারে, মূলত তখনই সে মুক্তি পায় এবং প্রতিকূল সময়কে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। আর গৌরবমুহূর্ত দ্ধারা সে প্রতারিতও হয় না।

আসলে উভয়েই উত্তীর্ণ হবে। একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাবে। এভাবে চক্রটি চলতে থাকবে যতক্ষণ না আমরা আমাদেরকে রক্তমাংস থেকে মুক্ত করতে পারি এবং যতক্ষণ না ‘স্বর্গীয় শক্তি’-কে আমরা খুঁজে পাই।

সুতরাং যখন কোনও যোদ্ধা ময়দানে থাকে — নিজের পছন্দেই হোক কিংবা অনির্ণেয় নিয়তির কারণেই হোক —  তার আত্মা যেন আসন্ন যুদ্ধের কথা ভেবে আনন্দে পরিপূর্ণ থাকে। সে যদি তার সম্মান ও ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে পারে, তাহলে সে যদি হেরেও যায়, সে কখনও পরাজিত হবে না। কারণ তার আত্মা অক্ষতই থেকে যাবে।

আর তার প্রতি যা-ই ঘটুক না কেন সে কাউকে দোষারোপ করবে না। জীবনে প্রথম সে যখন প্রেমে পড়েছিল ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তখনই সে জেনেছিল যে এ-ব্যর্থতা তার ভালোবাসার ক্ষমতাকে শেষ করতে পারবে না। প্রেমের ক্ষেত্রে যা সত্য, তা যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সত্য।

যুদ্ধে হারা কিংবা সর্বস্ব হারানো আমাদের জন্য দুঃখের মুহূর্ত নিয়ে আসবে, কিন্তু এই মুহূর্তগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত শক্তিকে আবিস্কার করতে পারব। এটা এমন এক শক্তি যা আমাদেরকে চমকে দেবে, আর বৃদ্ধি করবে আমাদের আত্মমর্যাদা।

আমরা চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজেদেরকে বলব : ‘আমি টিকে গেছি।’ আমাদের কথা দ্ধারাই আমরা অভিনন্দিত হব।

যারা এই অন্তর্গত শক্তিকে চিনতে পারবে না, শুধু তারাই বলবে : ‘আমি হেরে গেছি’, আর দুঃখ তাদের পিছু ছাড়বে না।

অন্যরা তাদের পরাজয়জনিত দুর্দশা ও অসম্মান সত্ত্বেও হয়তো দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলবে, কিন্তু আত্মকরুণার কাছে নিজেদের সঁপে দেবে না। তারা জানে যে এটা যুদ্ধের মাঝখানে একটা বিরতি মাত্র, এবং তাদের এ অসুবিধাও সাময়িক।

তারা তাদের আপন হৃৎকম্পন শোনে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও ভীত হওয়ার ব্যাপারেও তারা সজাগ। তারা এটা আবিষ্কার করে যে, ভীতি সত্ত্বেও, তাদের বিশ্বাস এখনও তাদের আত্মায় জীবন্ত রয়েছে আর তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কোনটা ভুল করেছে আর কোনটা ঠিক করেছে এ নিয়েও তারা কাজ করে। পরাজয়ের সময়টায় বিশ্রাম করে তারা এর থেকে ফায়দা তুলে নেয়, তাদের ক্ষতগুলো নিরাময় করে, উদ্ভাবন করে নতুন কৌশল আর নিজেদেরকে আরও ভালো অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত করে।

অতঃপর কোনো-এক প্রদোষে আবার যুদ্ধ এসে কড়া নাড়ে দরোজায়। এখনও তারা ভীত, কিন্তু তাদেরকে উঠে দাঁড়াতে হবে — হয় জয় না-হয় চিরতরে মাটিতে শুয়ে থাকা। অতীতের যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে তাদের, যা তারা আর সহ্য করতে চায় না। তারা জেগে ওঠে ও শত্রুকে মোকাবেলা করে।

তাদের আগের পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে এবার তারা অবশ্যই বিজয়ী হবে। কারণ তারা আর একই ব্যথা পুনর্বার সইতে চায় না।

কিন্তু এবারও যদি তাদের বিজয় না আসে, পরেরবার আসবে। পরেরবারও যদি না আসে তাহলে তারও পরবর্তী  সময়ে বিজয় আসবে। আসল কথা হচ্ছে নিজের প্রতি আস্থা রাখা।

শুধু সেই ব্যক্তিই পরাজিত হয় যে হাল ছেড়ে দেয়। অন্য সবাই বিজয়ী।

এমনও দিন আসবে যখন সেই কঠিন মুহূর্তগুলি গর্বভরে বলার মতো গল্পে পরিণত হবে। যারা এ গল্প শুনবে তারা শ্রদ্ধার সাথেই শুনবে এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিশ তারা শিখবে :

সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করো।
পরবর্তী সুযোগ হাতছাড়া হতে দিও না।
নিজের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে গর্ব অনুভব করো।

ক্ষতচিহ্ন হলো শরীরের ওপর সেঁটে থাকা মেডেল স্বরূপ। এগুলো দেখে তোমার শত্রুরা ভীতসন্ত্রস্থ হবে কারণ এসব ক্ষতচিহ্ন যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রমাণ। এটা প্রায়ই তাদেরকে বিরোধ এড়িয়ে যেতে ও সংলাপে বসতে প্ররোচিত করবে।

ক্ষতচিহ্ন সেই তরবারীর চেয়েও শক্তিশালী যেটা তাদেরকে জন্ম দিয়েছিল।

পরাজিত তারাই যারা কখনও ব্যর্থ হয় না।

পরাজয় মানে এ-ই যে আমরা কোনও বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা যুদ্ধে হেরে যাই। ব্যর্থতা কখনও আমাদেরকে লড়াই করতে সায় দেয় না।

পরাজয় তখনই আসে যখন আমরা যা ভীষণভাবে চাই তা পেতে ব্যর্থ হই। ব্যর্থতা আমাদেরকে স্বপ্ন দেখতে দেয় না। এর উদ্দেশ্য হলো : ‘কিছুই প্রত্যাশা কোরো না তাহলে তুমি হতাশ হবে না।’

আমরা যখন অন্য-একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হই তখন পরাজয়ের সমাপ্তি ঘটে। ব্যর্থতার কোনও শেষ নেই : এটা এক আজীবন বাছাই।

পরাজয় তাদেরই জন্য যারা আতঙ্ক সত্ত্বেও উদ্দীপনা ও বিশ্বাস নিয়ে বাস করে।

নির্ভীকদের জন্য নয় পরাজয়। শুধু তারা জানে হেরে যাওয়ার মধ্যে কি সম্মান আর জেতার মধ্যে কতোটা আনন্দ।

পরাজয় যে জীবনের অংশ এটা বলার জন্য আমি এখানে আসিনি : আমরা সবাই তা জানি। কেবল পরাজিতরাই ভালোবাসতে জানে। কারণ আমরা জীবনের প্রথম যুদ্ধটা প্রেমের ময়দানেই করি — আর স্বাভাবিকভাবেই তাতে পরাহত হই।

আমি আজ এখানে এ কথাটি বলতেই হাজির হয়েছি যে, পৃথিবীতে এমন লোকও আছে যারা কখনও পরাস্ত হয়নি।

আর ঐসব লোক তারাই যারা কখনও লড়াই করেনি।

তারা জখম, অসম্মান, অসহায়ত্ব, এমনকি ঐ-সমস্ত মুহূর্তকেও পাশ কাটাতে পেরেছে যখন যোদ্ধারাও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সন্দেহ করে।

এ ধরনের মানুষ গর্বভরে বলতে পারে : ‘আমি কখনও যুদ্ধে হারিনি’। অন্যদিকে তারা কখনোই এটা বলতে সক্ষম হবে না যে : ‘আমি যুদ্ধে জিতেছিলাম।’

এমন নয় যে তারা খুব পরোয়া করে। তারা এমন এক জগতে বাস করে যেখানে তারা নিজেদেরকে অদম্য ভাবে; অন্যায় ও ভোগান্তির প্রতি চোখ বুঁজে থাকে তারা; নিজেদের নিরাপদ ভাবে, কারণ তাদেরকে নিত্যদিনের চ্যালেঞ্জ নিতে হয় না, যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় ঐসব মানুষদের যাদের নিজ সীমার বাইরে চলে যাওয়ার ভয় থাকে।

তারা কখনোই ‘গুডবাই’ শব্দটি শোনেনি। কিংবা এ-কথাটিও তারা শোনে নি — ‘আমি ফিরে এসেছি। আমাকে আলিঙ্গন করো, একবার হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়ার মতো উন্মাদনায়।’

যারা কখনও পরাজিত হয়নি, আপাতদৃষ্টিতে তাদেরকে সুখী ও শ্রেষ্ঠ মনে হয়। তাদেরকে এমন এক সত্যের অভিভাবক মনে হয় যা অর্জন করতে তাদেরকে কখনও একটি আঙুলও তুলতে হয়নি। সব-সময় সবলের পক্ষে থাকে তারা — যেন হায়না, সিংহের ফেলে-যাওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকে।

তারা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দেয় : ‘বিরোধে জড়িও না, তাহলে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হবে। তোমার সন্দেহগুলোকে তোমার মধ্যেই রাখো, তবেই তোমার কোনও সমস্যা থাকবে না। কেউ যদি তোমাকে আক্রমণ করে, নিজেকে আক্রান্ত ভেবো না কিংবা প্রত্যাঘাতের মাধ্যমে নিজেকে ছোটও করো না। জীবনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।’

রাতের নিস্তব্ধতায় তারা তাদের কাল্পনিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় : তাদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো, ঐসব অন্যায় যেগুলো তারা দেখেও দেখেনি, অন্য মানুষ থেকে লুকাতে পারা কাপুরুষতার মুহূর্তগুলো — যেগুলো তারা নিজেদের থেকে লুকাতে পারে নি — আর প্রেম, চোখে স্ফুলিঙ্গ নিয়ে তাদের পথ অতিক্রম করা সেই প্রেম, ঈশ্বর যে-প্রেম তাদের জন্য সাব্যস্ত করেছিলেন, কিন্তু সাহসের অভাবে তারা তা আলিঙ্গন করতে পারেনি।

এদিকে তারা নিজেদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় : ‘কালকের দিনটি অন্যরকম হবে।’

কিন্তু কালকের দিনটিও চলে আসে আর সবকিছু-অবশ-করে-দেয়া প্রশ্নটি তাদের মনে ঘুরপাক খায় : ‘আজও যদি না-হয় তবে কী হবে?’

এজন্য তারা কিছুই করে না।

তাদের জন্য করুণা হয় যারা কখনও পরাজিত হয়নি! তারা এই জীবনে কখনও বিজয়ী হতে পারবে না।

# # #
এইরকম আরও পোস্ট
- Advertisment -
ad place