Tuesday, December 23, 2025
Homeসবিশেষওসমান সমাচারওসমান সমাচার পর্ব ১ । আহমদ মিনহাজ

ওসমান সমাচার পর্ব ১ । আহমদ মিনহাজ

ওসমানের গল্প : রাক্ষস ও সেলিব্রেটি সমাচার

এই গল্পটি ওসমানকে নিয়ে। ওসমান আমাদের শহরে থাকে। আমরা তাকে হাতের তালুর মতো চিনি। আমাদের শহরটি ছোট হলেও লোকের ভিড়ে সারাক্ষণ গিজগিজ করে। ভিতরে মানুষ উপচে পড়ছে। বাইরে থেকে বিস্তর লোক প্রতিদিন শহরে যাওয়া-আসা করে। এতো লোকের ভিড়ে সবাইকে চেনা সম্ভব নয়। চেনা জরুরি নয়। তবে কিছু লোক থাকে যাদেরকে চিনতে হয় না। নানা কারণে তারা সকলের পরিচিত। চেহারায় না হলেও নামে পরিচিতি। মাঝেমধ্যে গতকালের অচেনা লোক কিছু একটা ঘটিয়ে সকলের পরিচিত হয়ে ওঠে। এইসব পরিচিত লোকজনের গল্প আমরা শুনবো। সময় হলে তারা সেখানে জায়গা করে নেবেন। আবার অপরিচিত কোনো লোক গল্পের প্রয়োজনে এসে পড়তে পারে এবং আসবেও। ওসমান তাদের সবার থেকে আলাদা। প্রথমত এই গল্পটি তাকে বাদ দিয়ে হওয়ার উপায় নেই। ওসমানকে বাদ দিলে শহরের গল্প বাদ পড়ে যায়। শহরকে বাদ দিলে ওসমানের গল্প বাকি থেকে যায়। আমরা সে গল্প থেকে ছিটকে পড়ি। সুতরাং এটা নিছক কোনো শহর কিংবা ওসমানের গল্প নয়, —আমরা সেই গল্পের অংশীদার।

মুশকিল হচ্ছে খোদ ওসমানকে নিয়ে। সে আমাদের অস্তিত্বের অংশ। শহরে তার চলাফেরা আমরা স্পষ্ট টের পাই, অথচ তাকে দেখতে পাই না। অস্তিত্বের অংশ হয়েও সে এর বাইরে ঘোরাফিরা করে। অনিশ্চিত প্রশ্নবোধক হয়ে আমাদের পেছনে লটকে থাকে। ওসমান নেই এটা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না। আবার সে আছে এই বিশ্বাসে অটল থাকা কঠিন হয়। কারণ আমরা তাকে দেখতে পাই না। অনেক চেষ্টা করে তার নাগাল পাওয়া যায় না। ফলে ওসমানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার মেঘে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন থাকে। অনুমান ও জল্পনার উপর নির্ভর করে বেঁচে রয়। সে বাস্তব হয়েও বায়বীয়। তার এই দ্বৈত উপস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে শহরে আমাদের দিন কাটে। আমরা তাকে প্রতিদিন অনুসরণ করি। শহরের অলি-গলিতে তাকে তালাশ করি। তার উপস্থিতি টের পেলে তাকে অনুসরণ করি। সুতরাং এই গল্পটি ওসমানকে অনুসরণের গল্প। তার সঙ্গে আমাদের লুকোচুরি খেলার গল্প। এভাবে হয়তো অন্য এক জগতে ঢুকে পড়ার গল্প। তবে মূল গল্পে প্রবেশের আগে পেছনের গল্পটি বলে নেয়া প্রয়োজন। এতে করে ওসমানকে আমরা চিনতে পারবো। তার সঙ্গে আমাদের জড়িয়ে পড়ার কাহিনী খোলাসা করা সম্ভব হবে।

ওসমানকে নিয়ে পেছনের গল্পটি পুরাতন হলেও খুব বেশি পুরাতন নয়। কয়েক পুরুষ ধরে আমরা এই অভিজ্ঞতা যাপন করছি। এদিক থেকে ভাবলে গল্পটি অনেক পুরোনো। বয়সের ভারে অবসন্ন। অন্যদিকে আজকের ছেলেমেয়েরা ওসমানের গল্প শুনে বড়ো হয়েছে। আগামী দিনেও সেটা বজায় থাকবে বলে মনে হয়। ফলে গল্পটিকে পুরোনো ভাবতে দ্বিধা জাগে। ওসমান এমন এক বাসি গল্প যেটি কখনো বাসি হয় না। তামাদি হয়েও তামাদি হয় না। এই গল্পের শুরু আমরা জানি না। এর পরিশেষ সম্পর্কে আজো নিশ্চিত নই। শুধু এটা জানি ওসমান আমাদের মতো নয়। সে হলো রাক্ষস। রাক্ষস বংশে তার জন্ম হয়েছে। আমরা এটা দেখে অভ্যস্ত যে শহরে কোনো ফুলের দোকান নেই। ওসমানের কারণে নেই। সে হচ্ছে ফুলখেকো রাক্ষস। ফুলের কেয়ারি সাবাড় করা তার পেশা।

ওসমানকে নিয়ে পেছনের গল্প বলতে এটুকুই। বাকিটা নিরেট বর্তমান। আমরা সেই বর্তমানের অংশীদার হয়ে শহরে বেড়ে উঠি। বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। আয়-রোজগারের ধান্ধা করি। ঘর-সংসার ও বাজার-সদাইয়ে নিজেকে ক্ষয় করে চলি। কখনো-বা বাসনার চোরাটানে ভাসি। এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে পাড়ি জমাই। মাঝেমধ্যে শখের দেশ-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। সমানে রেস্তোরাঁয় ঢুকি। সুযোগ পেলে নদীতীরে বিকালের ভ্রমণটা সেরে ফেলি। অবসরে টিভি-পর্দায় নিজেকে বিনোদিত করার চেষ্টা করি। খবরের কাগজে চোখটোখ বুলাই। বয়স হলে ঘন-ঘন হাসপাতালে যাওয়া-আসা শুরু হয়। এভাবে একদিন আকস্মিক খাটিয়ায় উঠে পড়ি। আতুরঘর থেকে খাটিয়াঘরের পুরোটা সময় ওসমান আমাদের অনুসরণ করে। ছায়ার মতো পিছনে লেপটে থাকে। শহরের অলি-গলি চষে বেড়ানোর সময় তাকে আমরা টের পাই। শৌখিন ফুলের কেয়ারিতে তার উপস্থিতি অনুভব করে বিমূঢ় হয়ে পড়ি। বুনো ফুলের ঝোঁপে তার নড়াচড়া টের পাই। আমরা বুঝতে পারি ওসমান ফুল চুরি করছে।

‘কিতা বা, মাছটাছ পাইলায় নি।’ তারা হেসে উত্তর করে,- ‘আর মাছ! থাকলে তো পাইতাম! সব ওই ওসমানোর পেটে গেছে। হালার বেটা রাক্ষসের বাইচ্চা কুছতা বাকি রাখছে না। একলা সব মাছ সাবাড় করছে!’ তাদের উত্তরে মনে আশা জাগে। তবে কি ওসমান বিল এখনো ছাড়েনি! আমরা আশাবাদী হই,- ‘ইতা কিতা কও! ওসমান অখনো বিলে!’ আমাদের বিস্ময়ে তারা হাসে,- ‘ওসমান নাই কুনখানে কও! যেম্নেদি চাইবায় হেরে দেখবায়।’

আমাদের এই শহরে কোনো ফুলের দোকান নেই। ফুল একটি কেনাকাটার বস্তু হতে পারে বলে লোকে এখানে বিশ্বাস করে না। ফুল ক্রয়ের সাথে আমরা অভ্যস্ত নই। শহরের শৌখিন ও বিত্তবান লোকেরা বাড়ির আঙ্গিণায় ফুলের চাষাবাদ করে। বন-বাঁদাড়ে গেলে জংলী ফুলের দেখা মিলে। প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা যথেষ্ট। ফুলপ্রেমীরা এখানে ফুল চাষের খামার না করে বাগান করে। সেই বাগানে ভ্রমর ও প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। গাছের যত্ন নেয়ার জন্য মালী রাখার বিধান রয়েছে। ফুল গাছের বাড়-বাড়ন্তের গুরুদায়িত্ব তারাই পালন করে। বুনো ফুলের কপালে অবশ্য মালীর আদর জোটে না। প্রকৃতি নিজের হাতে তার কলি ফোটায়।

বাগানের ফুল ও বুনো ফুলের তফাত আমরা বিলক্ষণ বুঝি। উভয়ের গঠন ও গন্ধের ভিন্নতা চট করে বলে দিতে পারি। বাগানের ফুলগুলো নাজুক হয়ে থাকে। এক মিনিটের অযত্ন তারা সইতে পারে না। মালীর উপর নির্ভরশীল ফুলদল সামান্য অবহেলায় শুকিয়ে যায়। অন্যদিকে বুনো ফুলের সম্বল হচ্ছে টিকে থাকার দুর্বার প্রাণশক্তি। আমরা বিশ্বাস করি বাগানের ফুল ফোটে পুষ্পপ্রেমী ও মালীর হুকুমে। আর বুনো ফুল স্বয়ং ঈশ্বরের আদেশে ফোটে। ইশ্বরকে আমরা ভালোবাসি। মন্দিরে তার আরাধনা করি। গির্জায় ও মসজিদে তার নামে উপাসনা হয়। শহরটি বিশ্বাসীর তীর্থভূমি। অজ্ঞেয়বাদী ও সংশয়ীরা এখানে টিকতে পারে না। অবিশ্বাসী পা শক্ত করে দাঁড়াতে পারে না। কেউ অবিশ্বাসী হলে আমরা তাকে দ্রুত ধরে ফেলি ও শহর থেকে বিতাড়িত করি। কারণ আমরা শুরু ও সমাপ্তিকে মেনে চলি। ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তনে বিশ্বাস রাখি। জীবনের শুরু ও পরিণাম নিয়ে শহরে কেউ ঝগড়া করে না। এটা হচ্ছে এখানকার রীতি।

আমাদের শহরটি স্থিরতা ও নিশ্চিন্তির ছকে বাঁধা। এই শহরে একটি নদী রয়েছে। অধিক চওড়া নয়। এক পারে দাঁড়ালে অন্য পার চোখে পড়ে। প্রস্থে খাটো হলেও লম্বার দিক থেকে সে খুব দীর্ঘ। প্রাচীন এই নদীটি শহরকে বাসযোগ্য করেছে। বসত-বাড়ি ও কারবারির পত্তন ঘটিয়েছে। সে ক্ষীণকটি। তার মধ্যে নাচুনি-ভাব প্রকট নয়। ভরা বর্ষায় উপচে পড়লেও কালেভদ্রে মাতঙ্গিনী কালী হয়। নদীটি এক নিস্তরঙ্গ ডোবা। স্থিরতার আরামে বয়ে চলে। তন্দ্রা ও জাগরণের মাঝখানে আলস্যে গা ভাসিয়ে চলে। ক্ষীণকটি নদী শহরের প্রতি বিশ্বস্ত। নিজেকে নিয়ে সুস্থির ও নিশ্চিন্ত। নদীর বুকে ভাসমান প্রমোদতরী বিনোদনপ্রিয় মানুষকে আমোদ যোগায়। লোকেরা শখের নৌ-বিহার সারে। প্রমোদতরী তার নিজেকে নিয়ে নিশ্চিন্ত। নদীর নিস্তরঙ্গ স্রোতে তার আলোকমালা নিশ্চিন্ত মনে গুঞ্জরিত হয়। নদীতীর ঘেঁষে বিস্তৃত দোকানীরা সে নিয়মের বাইরে নয়। তারাও নিশ্চিন্ত। নদীর উপরে শতবর্ষী সেতুটি নিজের মরিচধরা কাঠামোর উপরে নিশ্চিন্ত। সময়-সংকেত দিতে-দিতে ক্লান্ত ঘড়িটি অচলপ্রায় হলেও তার নিশ্চিন্তির তুলনা হয় না!

এই শহরে কোনোকিছু অনিশ্চিত নয়। কেউ কিছু নিয়ে বিরক্ত নয়। লাল ইটের কয়েদখানাটি বয়সের ভারে পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে, তবু তার কোনো বিরক্তি নেই। মাছের আঁশটে গন্ধে ডোবানো বাজারটি নিজের উপর একটুও বিরক্ত নয়। রোগী ও সেবিকার হট্টগোলে ভরা বিকট হাসপাতাল কোলাহলে বিরক্ত ও বিচলিত হয় না। শহরটি পুণ্যভূমি নামে খ্যাত। সাধু পুরুষরা এখানে বিচরণ করেছেন। কিংবদন্তির দরবেশ জায়নামাজে চড়ে শহরে ঢুকেছিলেন। জাদুটোনায় ওস্তাদ রাজার সঙ্গে তার কঠিন লড়াই হয়। সে-লড়াইয়ে রাজা হার মানে। মানুষ নতুন বিশ্বাসের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। দরবেশের সমাধিতে প্রতিদিন লোক উপচে পড়ে। মানুষ দূর-দুরান্ত থেকে সেখানে আসে। তার অলৌকিক কীর্তি শুনে বিমোহিত হয়। দরবেশের সমাধিপাশে সুউচ্চ মিনার রয়েছে। মিনারটি নিজের উচ্চতা নিয়ে সন্তুষ্ট। আমরা সেই মিনারের অংশ। নিজেকে নিয়ে সুস্থির ও নিশ্চিন্ত। শুধু ওসমান ছাড়া!

আমাদের কাছে ওসমান এক আপদ নামে স্বীকৃত। আপদটি সম্পর্কে আমরা আজ অব্দি নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। সে আমাদের সঙ্গে থাকে না। দালান-কোঠার ধার ধারে না। আমরা তাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে পারি না। অথচ তার উপস্থিতি আমাদের হাতের আঙুলের চেয়ে বেশি নিশ্চিত। সে আমাদের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। কারো-না-কারো ঘরে সিঁদ কেটে ঢুকে পড়ে। ঘরের ভিতরে তার হামাগুড়ি সকলে স্পষ্ট টের পাই। ফুলের বাগানে পায়ের আওয়াজ শুনি। মাঝরাতে নির্জন রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বুঝতে পারি কেউ পিছু নিয়েছে। রিকশা থেকে নামার সময় কাঁধের উপর ভারী হাতের চাপ টের পেয়ে পিলে চমকে ওঠে। আড্ডা বা প্রেমালাপের তুঙ্গ মুহূর্তে আমাদের মাঝখানে কে যেন চুপচাপ শুয়ে থাকে। তার গায়ে শ্যাওলা জমানো। বুনো গাছ-গাছালির গন্ধ শরীরে। আমাদের গা গুলিয়ে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি ওসমান বন-বাদাড় ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকেছে।

শহরে গ্রীষ্ম নিয়ম করে আসে। টসটসে ফলের রসে বাজার ভরে ওঠে। প্রচণ্ড দাবদাহে সেদ্ধ হওয়ার সময় আমরা অনুভব করি ওসমান আমাদের সঙ্গে ঘামছে। বৃষ্টি শুরু হলে গ্রীষ্মের প্রকোপ কমতে থাকে। মুষলধারে বর্ষা নামে শহরে। কদম ফুল ফোটে। বৃষ্টিতে ভিজে ট্যাক্সিতে উঠার সময় হঠাৎ টের পাই ওসমান আমাদের পাশে বসে রয়েছে। একমনে কদম ফুল চিবাচ্ছে। জ্যোৎস্না রাতে আমরা ব্যালকনিতে দাঁড়াই। আকাশ-ভাসানো জ্যোৎস্নায় গানের কলি গুনগুন করে গাইতে থাকি। আমাদের সঙ্গে অদৃশ্য এক কণ্ঠ তাল মিলায়। আমরা বুঝতে পারি ওটা ওসমান! আপদটা জ্যোৎস্নারাত দেখে ঠিকঠাক হাজির হয়েছে। ঋতু তার নিয়ম অনুসারে পালটায়। বর্ষা শেষে শরৎ আসে। তালপাকা গরমে আমরা ছটফট করি। আমাদের সঙ্গে ওসমান ছটফট করে। বিলের ধারে কাশবন ফুলে-ফুলে সাদা হয়। আমরা কাশবনে তাকে খুঁজি। সাদা কাশফুলের গভীরে সে হারিয়ে যায়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শেষে হেমন্তের আভাস জাগে। শহরতলির বাতাসে পাকা ধানের গন্ধ ছুটে। ওসমান সেই ধানের গন্ধে মিশে রয়। ঝরা পাতার আওয়াজ তুলে হেমন্ত বিদায় নেয়। গভীর শীতের রাতে গায়ে লেপ টানার সময় টের পাই আমাদের পাশে ঠাণ্ডা এক সাপ শুয়ে আছে। তার গায়ের চামড়া খসখসে। চ্যাপ্টা ঠোঁট দুটো শীতে ফেটে গেছে। চোখে উষ্ণতা নিবারণের ক্ষুধা। আমরা ভয়ে শিউরে উঠি। আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। উৎকণ্ঠায় গলা শুকায়। সাপ ওম চাইছে বুঝে লেপটা গায়ের উপর টেনে দেই। লেপের উষ্ণতা সাপের সহ্য হয় না। জানালার ফোকর গলে সে নিচে নেমে যায়।

শহরে বসন্তের আভা লাগে। বসন্ত এলে অজস্র ফুল ফোটে শহরে। ন্যাড়া গাছপালা কচি পল্লবে ভরে ওঠে। ওসমান বসন্ত ভালোবাসে। ফুলের সুগন্ধ তাকে উতলা করে ফেলে। তার উৎপাত সহ্যের সীমা ছাড়ায়। আমরা তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হই। অনুসরণ করে পরিত্যক্ত পার্কে পৌঁছাই। পার্কের পাশে বাতিল এক টানেলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। ওটার প্রবেশমুখে আমাদের পা আটকে যায়। আমরা আর এগুতে পারি না। শুধু টের পাই ওসমান টানেলের ভিতরে ঢুকছে। চতুর সরীসৃপ এঁকেবেঁকে ঢুকে যাচ্ছে টানেলের গহীন গুহায়। আমাদের শিড়দাঁড়া হিম হয়ে আসে। শরীরে কাঁপুনি জাগে। আমরা স্মরণ করতে বাধ্য হই যে ওসমান আমাদের কেউ নয়। রাক্ষসবংশে তার জন্ম হয়েছে। সে হলো ফুলরাক্ষস। ফুল ভক্ষণের নেশায় টানেল থেকে বের হয় এবং মেজাজ খারাপ হলে লোকের ঘাড় মটকায়! আজ সেটা ঘটেবে হয়তো।

রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমরা ত্রস্ত পায়ে বাড়ি ফিরি। দরোজা-জানালার ছিটকিনি ভালো করে পরখ করি। বিছানায় শুয়ে মুখ-অব্দি চাদর টেনে দিই এবং অবাক হয়ে লক্ষ করি ইজিচেয়ারটি দুলছে। কেউ সেখানে বসে নিশ্চিন্ত মনে দোল খাচ্ছে। তার চোখ-মুখ শান্ত। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি লেগে রয়েছে। মুখের বলিরেখা নিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। বায়বীয় এই নিশ্চয়তা আমাদের শিহরিত করে। আমরা ভয়ে ডুকরে উঠি। প্রাণপণে চোখ বুজে ফেলি। আমরা বুঝতে পারি ওটা হলো ওসমান। রাক্ষসটি আজ ফুল চুরি করতে বের হয়নি। ফুলের রসে তার তৃষ্ণা মিটছে না। পূর্বপুরুষরা তাকে ভর করেছে। ওসমান আজ ফুলের বদলে মানুষ নিতে বেরিয়েছে।

আমাদের জীবনে রাক্ষস ওসমান এক অভিশাপের নাম। তার কারণে আমরা বারবার বিড়ম্বিত হই। রাক্ষসের যখন-তখন আবির্ভাব ও আকস্মিক অন্তর্ধান স্নায়ুকে চাপে রাখে। নিজেকে আমরা সুস্থির রাখতে পারি না। নদীর আরামে প্রবাহিত হওয়ার সুখ নিতে পারি না। তার উৎপাত ঠেকাতে মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করি। নতুন উদ্যমে কাজে ডুব দেই। ভোর থেকে রাত-অব্দি চরকি হয়ে টাকার পেছনে ঘুরি। স্ত্রী ও সন্তানকে অধিক ভালোবাসতে থাকি। প্রবল উৎসাহে জনসেবায় লিপ্ত হই। শহরের অলি-গলিতে শীতবস্ত্র বিতরণে বেরিয়ে পড়ি। রেশন-কার্ড পুনরায় চালু করা যায় কিনা সেটা নিয়ে মুখর হই। পরিকল্পিত শহর গড়ার আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। ছড়া ও খাল উদ্ধারের জন্য প্রাণপণ খাটি। ফুটপাতে পা ফেলার জো নেই দেখে বিমর্ষ হই। আবর্জনা নিষ্কাশনের উপায় নিয়ে সভা-সেমিনার করি। টেকসই নগর-উন্নয়নের জন্য ঘন-ঘন সংলাপে বসি। আমরা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজনে মেতে উঠি। ওয়াজ ও কনসার্টে হাজির হই। বহুতল বিপণিবিতানে সিনেপ্লেক্সের অভাব বোধ করি। বিবাহ-উৎসবে সানন্দে ভুঁড়িভোজন সারি। শহরে কেউ মারা গেলে তাকে দেখতে যাই। শ্রাদ্ধ ও কুলখানির আয়োজনে হাত লাগাই। এতোসব ব্যস্ততার মাঝে প্রতিদিনের উপাসনায় আমাদের ভুল হয় না। স্ত্রীর সঙ্গে গভীর রাতের আবেগ-বিনিময়ে ত্রুটি ঘটে না। হাসপাতাল থেকে নবজাতকরা নির্ভুলভাবে বাড়ি ফিরে আসে। আমরা তাদের কোলে নেই। অকাতরে স্নেহ বিলাই। তাদের মধ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ বাড়ছে দেখে মনে-মনে খুশি হই। ভবিষ্যৎকে নিয়ে সকলে গোল হয়ে বসি। তাদের কাছে শহরের গল্প করি। দরবেশবাবা ও জাদুকরের কাহিনীটি শুনাই। ইন্দ্রজালের অলৌকিক মাহাত্ম্য বয়ান করি। ভবিষ্যতের কাছে আমরা চা-বাগানের গল্প করি। বাগান পত্তনের ইতিহাস শুনাই। এইসব ঘটনা ও গল্পের ফাঁকে ওসমান এসে আমাদের ঘাড়ে চাপে। আমরা নিজের অজান্তে তাকে বলতে শুরু করি। ওসমানের গল্পে আবিষ্ট হই। তার পিছু নিয়ে পরিত্যক্ত টানেলে ঢুকে পড়ি। টানেল পেরিয়ে শহরের নাভিতে পৌঁছে যাই। আমাদের চোখে-মুখে রাক্ষস আবিষ্কারের উত্তেজনা খেলা করতে থাকে। আমরা জল্পনায় বুঁদ হয়ে পড়ি।

মূল কথাটি হলো শহরে ওসমান নামে এক রাক্ষস থাকে। আমাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক জল্পনার রোমাঞ্চে ভরপুর। রাক্ষসরা বিশালদেহী ও হিংস্র হয়। তাদের চোখ ভাটার মতো জ্বলে। অট্টহাস্য বুকে কাঁপুনি ধরায়। বাপ-পরদাদার আমল থেকে রাক্ষসরা মানুষ ও জীবজন্তু ধরে খাচ্ছে। এটা তাদের পেশা। লোকের ধারণা ওসমান মানুষখেকো রাক্ষস নয়। কালেভদ্রে দু’চারটে মানুষ শিকার করলেও সে আসলে ফুলাহারী। অদ্ভুত এই স্বভাবের জন্য অনেকে তাকে ফুলচোর ওসমান নামে ডাকে। শহরের রমণী ও শিশুরা তাকে ফুলরাক্ষস ডাকতে পছন্দ করে। রাক্ষস জ্যান্ত মানুষ ধরে খায় আর ওসমান সাজানো ফুলের কেয়ারি সাবাড় করে। রাক্ষসের উদর ফার্নেসের মতো দিনরাত জ্বলে। সেই আগুনে জ্যান্ত মানুষ নাকি কাবাব হয়। ওসমানের উদরে ফুল প্রজাতিরা গলেমিশে হাপিস হয়। রাক্ষসরা মানুষের মতো রান্না-বান্না জানে না। শিকার পেলে গপাগপ মুখে পুরে দেয়। ফুলভুখ ওসমান সেদিক থেকে শৌখিন। প্রচণ্ড খিদে না পেলে কাঁচা খাবার মুখে তোলে না। তার খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক নিয়ে শহরে জল্পনার অন্ত নেই। লোকে বলে ওসমানের ডেরায় হামানদিস্তার মতো দেখতে অতিকায় দুটি মাড়াই যন্ত্র রয়েছে। এর একটি ফুলের ডাটা পিষে রস বের করার জন্য, অন্যটি ব্লেন্ডার মেশিনের কাজ করে। মেশিনের তীব্র ঘূর্ণনে ফুলের কচি পাপড়ি গলিত সুগন্ধে পরিণত হয়। সুগন্ধটি সোনালী রঙ ধারণ করা পর্যন্ত ওসমানের অপেক্ষা শেষ হয় না। ডাটা ও ফুলের রস একত্রে মিশিয়ে সে পান করে। রসের প্রভাবে চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে পড়লে টানেলের চাতালে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। মাথার উপরে ভাসমান মেঘদলকে সম্বোধন করে প্রলাপে বিদীর্ণ করে নিজেকে। ফুলরাক্ষসের নাম শুনলে বাচ্চারা আপনা থেকে চোখ বুজে ফেলে। মানুষখেকো রাক্ষসের চেয়ে ফুলখেকো তাদের জল্পনায় অনেক বেশি আজব ও শিহরনকর বলে গণ্য হয়।

জল্পনার এখানে শেষ নয়। ওসমানকে আমরা কেউ দেখি না। টের পেলেও নাগালে পাই না। অনুসরণ করলেও পাকড়াও করতে পারি না। যদিও তার অস্তিত্ব নিয়ে কারো মনে সংশয় নেই। জল্পনা ও অনুসরণের বিরাম নেই। শহরের ফাঁক-ফোকরে আমরা তাকে খুঁজি। লোকের ভিড় বাঁচিয়ে যেটুকু অলস জায়গা পড়ে আছে সেখানে খুঁজি। বুনো ফুল ও জলা-জঙ্গলায় ভরা বিলে অনুসন্ধান করি। একদিন এই বিলে ওসমান নাকি রাজত্ব করে বেড়াতো! ভরা বর্ষায় বিলটি পদ্ম ও শাপলা-শালুকে ছেয়ে যেতো। শুকনো মৌসুমে তার আবার অন্য চেহারা হয়। বর্ষার ঢল নেমে গেলে বিলের কাদাপানিতে মাছ শিকারের ধুম পড়ে। বিলের চারধার ঘেঁষে জলা-জঙ্গলা ও ঘাসি জমির বিস্তার ছিল দেখার মতো। সাপখোপ ও জোঁকেরা সেখানে নিশ্চিন্ত মনে চরে বেড়াতো। ঘাসি জমি মহিষ চড়ানোর জন্য উপযুক্ত হয়ে থাকে। পায়ে লোহার আংটা বাঁধা কয়েদিরা কাকভোরে মহিষের পাল নিয়ে বিলের দিকে রওয়ানা হতো। জেলের ভিতরে গরু-মহিষের বিরাট বাথান ছিল তখন। পুলিশী পাহারায় বিলের ঘাসি জমিতে মহিষ চড়ানো ও দুধ দোহন করার কাজটি জেলখাটা কয়েদিরা করতো। জেল কোড অনুসারে এটা ছিল বাধ্যতামূলক। সশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামির জন্য কর্তৃপক্ষ এই শাস্তির বিধান করেছিল। এছাড়া জেলার সাহেবের বাগান পরিচর্যা করা কয়েদির রুটিন কাজের অংশ ছিল। মহিষের পাল খেদিয়ে বাথানে ফেরার সময় তাদের দুই হাতে ভাটফুল উপচে পড়তো। কয়েদিরা সেগুলো নিজের কাছে রাখতো না, বাচ্চা-কাচ্চার মাঝে বিলিয়ে দিতো। কয়েদখাটা দাগি আসামি ও শাড়ি-চুড়ি বিক্রেতা ফেরিওয়ালা ছিল শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা খবর সংগ্রহে পটু হয়ে থাকে। শহরের কোথায় কী ঘটছে সেই তথ্য পরিবেশনে তাদের জুড়ি মেলা ভার। কয়েদির ঝুলিতে ওসমান-প্রসঙ্গ ছিল চাটনির মতো মুখরোচক:

‘ওসমানকে আজ বিলে শাপলা ও ভাটফুল কুড়াতে দেখা গেছে। পানির মধ্যে তার সবজে-হলুদ শরীরটি গোক্ষুর সাপের মতো সাঁতার কাটছিল। আজ সম্ভবত সে আর বিল থেকে উঠবে না। ’

‘মনা রায়ের টিলায় লুটকি ফুলের বাহার কেউ আর দেখতে পাবে না। ওসমান পুরো টিলা একা সাবাড় করেছে।’

‘জেলের পাগলা ঘণ্টা বাজার কারণ কোনো কয়েদি নয়। ওসমান পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। জেলার সাহেবের বাগানে যতো জিনিয়া ও গাঁদা ফুটেছে তার একটিও আর নেই। সব ওই ব্যাটার পেটে গেছে।’

‘অনেক দিন পর ওসমান আজ একটা মানুষ শিকার করেছে। বিধূভূষণের অনাথ ছেলেটি সেই সকাল থেকে নিখোঁজ। বিলের ধারে তার রক্ত-মাংস ও নাড়িভুঁড়ি পাওয়া গেছে। ফুলখেকো রাক্ষস অনাথ ছেলেটিকে একলা সাবাড় করেছে!’

বিলের পারে দাঁড়িয়ে আমরা ওসমানের জন্য অপেক্ষা করি। মনে আজগুবি স্মৃতিরা ভেসে ওঠে। সকলে এক-দৃষ্টে বিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিলটি আগের অবস্থায় নেই। শুকিয়ে যাচ্ছে। দখলদারের চাপে ছোট হয়ে আসছে। অগাধ জলরাশি নিয়ে আগের মতো সুগম্ভীর নয়। স্বচ্ছতোয়া ও গভীর নয়। ঘাসি জমিতে বিরাট বস্তি গড়ে উঠেছে। বিলের আশপাশ ছাড়া জলা-জঙ্গলার অস্তিত্ব নেই বললে চলে। মানুষের সাথে টিকতে না-পেরে সাপখোপ ও জোঁকেরা পালিয়েছে। বিলের উপর দুএকটা ঘাসি নৌকা শুধু চোখে পড়ে। পোনা-টেংরা পাওয়ার আশায় জেলেরা জাল ফেলছে। একদা এই বিলে দশাসই রুই-কাতলা-বোয়াল ভেসে উঠতো। এখন তাদের ছানাপোনার দেখা পাওয়া ভার। আমরা তবু আশায় থাকি। মনে-মনে ওসমানের অপেক্ষা করি। বলা তো যায় না বিল তোলপাড় করে সে উঠলেও উঠতে পারে।

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। বিল ফুঁড়ে কোনো রাক্ষস উঠে আসে না। ঘাসি নৌকা তীরে ভিড়ে। জেলেরা ছোট খলুই নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। তাদের শরীরে বিলের পচা পানির গন্ধ উথলে উঠছে। আমরা হাঁক দেই,- ‘কিতা বা, মাছটাছ পাইলায় নি।’ তারা হেসে উত্তর করে,- ‘আর মাছ! থাকলে তো পাইতাম! সব ওই ওসমানোর পেটে গেছে। হালার বেটা রাক্ষসের বাইচ্চা কুছতা বাকি রাখছে না। একলা সব মাছ সাবাড় করছে!’ তাদের উত্তরে মনে আশা জাগে। তবে কি ওসমান বিল এখনো ছাড়েনি! আমরা আশাবাদী হই, —‘ইতা কিতা কও! ওসমান অখনো বিলে!’ আমাদের বিস্ময়ে তারা হাসে,- ‘ওসমান নাই কুনখানে কও! যেম্নেদি চাইবায় হেরে দেখবায়।’

জেলেরা কথা না-বাড়িয়ে জোর কদমে হাঁটা শুরু করে। তাদের দেখাদেখি আমরাও বিলকে পেছনে ফেলে হাঁটতে থাকি। কী বোকা আমরা! ওসমানকে বিলে খুঁজতে এসেছি। রাক্ষসটি হয়তো তার ডেরায় নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। পরিত্যক্ত পার্কে ফুলের কেয়ারির মাঝে শুয়ে আছে। হতে পারে সে হাইওয়ে ধরে হাঁটছে। সেখান থেকে শহরতলির দিকে নেমে গেছে। সে যে নদীর তীরে নেই এই নিশ্চয়তা কে দেবে! এমন তো হতে পারে ওসমান হয়তো আদালত চত্বরে ঝাঁকড়া রেইনট্রি গাছের মগডালে বসে দোল খাচ্ছে। আমাদের রান্নাঘর মাংসের ঘ্রাণে মউ-মউ করে। ওসমান হয়তো সেখানে গেছে। লোভী বেড়াল হয়ে মাংসের হাঁড়ির দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। সুযোগ পেলে মাংসের বাটি নিয়ে কেটে পড়বে। মাঝেমধ্যে তার রান্না করা মাংস খাওয়ার শখ চাপে। আজ হয়তো চেপেছে!

যার অবস্থান এতো অনিশ্চিত তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে লোক জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষে বিচরণ করে তার নাগাল পাওয়া সহজ নয়। নিজের বোকামিতে আমরা লজ্জিত হয়ে পড়ি। ওসমানকে নিয়ে আমাদের অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। সেলিব্রেটির পেছনে ধাবমান সংবাদকর্মীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সেলিব্রেটির পেছনে সংবাদকর্মীরা সুপার গ্লু’র মতো লেপটে থাকে। প্রয়োজনে শোবার ঘর বা বাথরুমে উঁকি দিতে দ্বিধা করে না। সেলিব্রেটি আত্মহত্যা করেছে শুনলে ফটো খিঁচতে ছুটে। তাকে তাড়া করার ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীর কোনো ক্লান্তি নেই। অতি উৎসাহী সংবাদকর্মীকে লোকে সাংঘাতিক বলে ডাকে। ওসমানকে তাড়া করতে গিয়ে আমরা হয়তো সাংঘাতিক হয়ে উঠেছি। বিষয়টি আমাদের পুলকিত ও ঈর্ষান্বিত করে। রাক্ষসটিকে আমরা ঈর্ষা করতে থাকি।

আমাদের অতি উৎসাহের কারণে ওসমান এখন সেলিব্রেটি হতে চলেছে। রাক্ষস ও সেলিব্রেটির মাঝে অসামান্য মিল এনে দিয়েছে। একজন সেলিব্রেটি সবখানে উপস্থিত থাকে। যেখানে যাও-না-কেন তাকে এড়ানো কঠিন। এমনকি সে না-থাকলেও মনে হয় আশেপাশে আছে। সেলিব্রেটি আমাদের ধরাছোঁয়ার গণ্ডিতে থেকেও গণ্ডির বাইরে ঘুরে বেড়ায়। তাকে নিয়ে আমরা কতোরকম স্বপ্ন দেখি, জল্পনায় রঙিন হই, অথচ তাকে ছুঁতে পারি না। সেলিব্রেটিকে আমরাই সেলিব্রেটি করি এবং সেলিব্রেটি হওয়ার পর তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলি। ইচ্ছে থাকলেও তুচ্ছ মাংসের পুঁটলিকে আর ছুঁতে পারি না। ওসমানের বেলায় এটা খাটে বৈকি! রাক্ষসটি আমাদের আশপাশে থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে!

নগণ্য এক রাক্ষসের কাছে হেরে যাওয়ার দুঃখ আমাদের অস্থির করে। ইচ্ছে হয় ওসমানকে নিয়ে সকল কৌতূহলের গলা টিপে ধরি। রাক্ষসটিকে যেন আর খুঁজতে না হয়! কিন্তু একবার যে সেলিব্রেটি হয়ে গেছে তার পক্ষে নিজেকে তুচ্ছ মাংসের পুঁটলি ভাবা কঠিন। সেলিব্রেটির আয়ু সচরাচর দীর্ঘ হয় না। একটা ঘোরের মধ্যে তার অধঃপতন ঘটে। হঠাৎ একদিন নিজেকে একা ও নিঃসঙ্গ আবিষ্কার করে সে মুষড়ে পড়ে। তার নামে কেউ আর করতালি দেয় না। সেলিব্রেটির জন্য ঘটনাটি শকিং। নিজেকে তুচ্ছ মাংসের পুঁটলি বলে সে ভাবতে পারছে না, অথচ কেউ তাকে পোছে না। সংবাদকর্মীর কলম ও ক্যামেরা তাকে ভুলতে শুরু করে। মানুষের স্মৃতি থেকে নামধাম অবলুপ্ত হয়। তুচ্ছ মাংসের পুঁটলির সমাধি ঘটে বিস্মরণের গর্ভে। ওসমান সেলিব্রেটি হওয়ার কারণে তার বিলুপ্তি অনিবার্য। এটা ভেবে আমাদের মন ভালো হয়ে ওঠে। আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করি। রাক্ষসকে তাচ্ছিল্য করতে পেরে মনে খুশির ঢেউ বহে।

খুশিটা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ ওসমান আমাদের পুনরায় দখল করে ফেলে। আমরা বাস্তবে ফিরে আসি। তার তালাশ শুরু করি। তাকে পাকড়াও করতে না পেরে নিজের উপর ক্ষুব্ধ হই। মানুষ কতো কী করছে! দিনকে রাত করছে সমানে! অথচ মানুষ হয়ে সামান্য এক রাক্ষসকে আমরা ধরতে পারছি না! পদে-পদে সে আমাদের নাকাল করে ছাড়ছে! নাহ, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। আমরা মেয়র সাহেবের সাথে দেখা করবো ঠিক করি। শহরের মান্যগণ্য মানুষ নিয়ে একবার বসা প্রয়োজন। মেয়র সাহেব ডাক দিলে উনারা নিশ্চয় আসবেন। সেখানে ওসমান-সমস্যা নিয়ে গুরুতর আলোচনা হতে পারে। সবাই মিলে বসলে রাস্তা বের হবেই। এভাবে দিনের-পর-দিন ওসমান-বন্দি হয়ে থাকা আর সহ্য হচ্ছে না। তার উপদ্রবে নিজেকে সুস্থির ও নিশ্চিন্ত রাখা যাচ্ছে না। এবার এসপার-ওসপার হওয়া প্রয়োজন। সেই আশায় আমরা মেয়র সাহেবের বাড়ির পথ ধরি।

(ক্রমশ)

এইরকম আরও পোস্ট
- Advertisment -
ad place